‘বিজ্ঞান’ ব্যাপারটা আসলে কী তা এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না। সেদিন তো গোমুখ্যুর মতন বলে দিলাম- আমি ‘বিজ্ঞান’ পড়ব। সেই দিন, মানে এইট থেকে নাইনে ওঠার সময়। কেন? সব থেকে আগে নিশ্চয়ই আমার ‘ভালো ছেলে’ ছাপটাই দায়ী ছিল এর জন্যে! ইস্কুলের ভালো ছেলে, ‘বিজ্ঞান’ ছাড়া আর কী-ই বা পড়তে পারে? বিজ্ঞান পড়তে গেলে, বুঝতে গেলে, পরীক্ষায় নম্বর পেতে গেলে, ধারালো মাথা লাগে। আর সেটা তো থাকে ভালো ছেলেদেরই। পরীক্ষায় নম্বর বিলি করার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তখনও শিক্ষকরা আয়ত্ত করতে পারেননি। কিংবা তাঁদের উপর নির্দেশও আসেনি নম্বরপ্রেমের মাহাত্ম্য প্রচারের। আর্টসে নম্বর ওঠে কচ্ছপের মতো- আর বিজ্ঞানের বেলায় ক্যাঙারুর মতো। অতএব ঢুকে পড়লাম বিজ্ঞানের আখড়ায়। সেই যে শুরু, এখনও বিজ্ঞান বয়ে চলেছি। বিজ্ঞান আমাকে সম্মান দিয়েছে, প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, প্রতিপত্তি দিয়েছে, বিত্ত দিয়েছে। কিন্তু! কিন্তু যখন নিজের বুকটায় হাত দিই- নিশ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দময়তার ভাঁজে ভাঁজে নিজের সত্তাকে খুঁজি তখন কোথায় যেন লাগে –অন্য কোথা- অন্য কোনোখানে। বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞান অভীক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা, বিজ্ঞান অনুশীলন এবং বিজ্ঞানের ভাবনা- সরলরেখায় হাঁটে না। মাফ করবেন, বিজ্ঞানীকুলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা অটুট রেখেই যা নিবেদন করতে চাই তা হল এই, ডিগ্রীসজ্জিত বিজ্ঞানের ‘ব্যাপারী’র অহংকার আসলে ফাঁপা অহংকার। বিজ্ঞানের সরল, স্বাভাবিক, সতত প্রবাহমান ধারার সাথে এর কোন লেনদেন নেই। আইনস্টাইন যখন বেহালা বাজান, চে গুয়েভারা যখন সাহিত্য করেন, বিভূতিভূষণ যখন বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন, পাবলো নেরুদা যখন ওড লেখেন, তখন এই ধারায় একইসাথে ঝলমল করে ওঠে বিজ্ঞান আর কল্পনা। হ্যাঁ, এই আশ্চর্য জোড়কলমের ক্ষমতা থাকবে তাদের হাতে যাদের চোখে আর মাথায় আছে বিজ্ঞান আর হৃদয়ে আছে ভালোবাসা। পাথরে পাথরে ঠুকে আগুন জ্বালানোর দিন থেকে, প্রমিথিউসের আগুন চুরির পথ বেয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের চুল্লীতে বিজ্ঞানই মানুষকে শক্তি দেয়, প্রকৃতির সাথে যুজতে বল যোগায়। শিম্পাঞ্জী থেকে মানুষ, মানব-মানবীর মিলন থেকে নলজাতক, ধূলিধূসর পৃথিবী থেকে নিতান্তই নির্মোহ ছাইরঙা চাঁদ এবং মেটেরঙা মঙ্গল- এ সবই হচ্ছে বিজ্ঞানের কারসাজী।
কোন ভাষাতে কথা বললে বিজ্ঞানের জোর বাড়ে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে এটা সত্যি যে গুহায় আগুন জ্বালানোর সময়, নিতান্ত বিরূপ প্রকৃতির লড়াই করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সময় গুহাবাসী অবশ্যই ইউরোপের ভাষায় কথা বলতেন না। গুলতি ছোড়া, ঘুড়ি ওড়ানো, শীত তাড়ানোর জন্য বন্যপশুর ছাল পরে নিয়ে উত্তাপ বাড়ানো, আরও পরে চাষ-আবাদ করে ফসল ফলানো, থাকার জায়গা জোগাড় করার জন্য – এগুলির কোনওটাতেই কিন্তু ভাষা বাঁধা পড়েনি।
জগদীশচন্দ্র বসু
তৈরী হয়নি দেওয়াল। মানুষ তখনও শুনে উঠতে পারেনি ফরাসী বুটের শব্দ কিংবা স্প্যানিশ বন্দুকের গর্জন। এর পরের গল্পটা আধিপত্ত্য কায়েমের- রাজত্ব প্রতিষ্ঠার, রাজ্য নির্মাণের। ভাষা এখানে হয়েছে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখার ‘অস্ত্র’। এই অনুভূতিও তৈরি করা হয়েছে ক্রমান্বয়ে যে ‘রাজভাষা’ ছাড়া অন্য ভাষাগুলি নিকৃষ্ট। মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের মেলবন্ধন ছাড়া কোন মনোগ্রাহী সৃষ্টি হয়না। অন্যভাবে দেখলে, জগঝম্প হয়, সুরসৃষ্টি হয় না। হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয়ে বয়ে চলা ভাষা বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করার কাজে, জীবনে প্রয়োগ করার কাজে অনেক বেশী বলশালী। রাজভাষার সাম্রাজ্যে ঢুকে তাকে মানিয়ে নেওয়া দরকার অবশ্যই কিন্তু মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। ‘বিজ্ঞানভাষ’- সেই অন্য পথেই হাঁটতে চায়।
‘বিজ্ঞানভাষ’-এর পথ চলায় বিজ্ঞান অবশ্যই মুখ্য প্রতিপাদ্য –কিন্তু বাংলা ভাষা তার ভেলা হবে। একটা অদ্ভুত ভাষার মাদকতার মধ্যে দিয়ে- বিশ্বায়িত পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। বাংলাভাষা নাকি মজে গেছে – কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। ‘বিজ্ঞানভাষ’ বলতে চায়- এ ভাবনা আত্মপ্রবঞ্চনা। আর ভাষার কৌলিন্য? তাও তো অনুভূতির বস্তু, সংস্কৃতি-সম্পৃক্ত ভাবনা। বহু বিজ্ঞানী বন্ধু আছেন- যারা এক-দুবছর ভ্রমণের পর এক অদ্ভুত ভাষায় শব্দ উচ্চারণ করতে শুরু করেন। কথা বলার মাঝে মাঝে বারবার বলতে থাকেন – ‘আমি যখন ‘ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক’-এ ছিলাম’ কিংবা ‘অমুক থিওরি নিয়ে গবেষণা করেছিলাম’ ইত্যাদি। ঝাড়গ্রাম, আলিপুরদুয়ার, পাথরপ্রতিমার গপ্পো করাটা লজ্জার বিষয় বলে মনে করেন। ‘বিজ্ঞানভাষ’ এর বাইরে একটা অন্য পরিসর তৈরি করতে ইচ্ছুক। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমটিমে হ্যারিকেন হয়ে ঝুলতে থাকা বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সলতেটাকে কেউ কেউ এখনও উশকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের হার্দিক ধন্যবাদ।
Add Comments