পরিবেশ বাঁচাতে কী কী করা দরকার তা নিয়ে নির্দেশিকার অভাব নেই। গত কয়েক দশকে পরিবেশ সংরক্ষণ ঘিরে তত্ত্বও তৈরি হয়েছে বেশ কিছু। এই সব তত্ত্ব এবং হাজার হাজার গিগাবাইট তথ্য সম্বল করে আন্তর্জাতিক, জাতীয়, আঞ্চলিক বা একেবারে স্থানীয় সম্মেলনের অভাব নেই। এত উদ্যোগে পরিবেশের সত্যিই কোনো উন্নতি ঘটেছে কিনা তা নিয়েও বিতর্কের ছড়াছড়ি। ‘উন্নত’ তকমা পাওয়া বিশ্বে যতটা সংরক্ষণ করা গিয়েছে ততটা করা হচ্ছে না ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোতে – এই নিয়ে চাপানউতোরে সরব হয়ে ওঠে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সভাগুলো। এত সব শোনার-জানার পরে সাধারণ নাগরিকের প্রশ্ন হয়, ‘ পরিবেশ বাঁচাতে আমি কী করতে পারি?’ এর সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন। একদিকে রাজনীতিবিদ এবং অন্যদিকে কৃষি ও শিল্পের মহারথীরা ঠিক করে দেন যে আমরা কতটুকু পেতে পারি বা পয়সা দিয়ে কিনতে পারি। তাঁরাই নির্ধারণ করেন যে কতটা অরণ্য শেষ করে রাস্তা বা চাষের ক্ষেত তৈরি হবে, কত কোটি গ্যালন জল ব্যবহার করে কত ইউনিট প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় সিমেন্টের বস্তা তৈরি হবে। সরবরাহ তাঁরাই করেন, সমাজে কেনার অনাগ্রহ তৈরি হলে তাঁরাই আরও টাকা ঢালেন বিজ্ঞাপনে। সেখানে সত্যিই কোনো ভূমিকা নেই নাগরিকের, বিশেষ মূল্য নেই নিজের উঠোনে খান দুয়েক গাছ লাগানোর বা কল বন্ধ রেখে কয়েক বালতি জল বাঁচানোর। এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলো নিঃসন্দেহে সদর্থক কিন্তু তার সুফল নষ্ট করে দেওয়ার জন্য খুব বড় মাপের প্রকল্প নেওয়া হয় সমাজে যার অব্যবহিত ফল হল দূষণ ও বিনাশ। ফলে পরিবেশ বাঁচানোর প্রশ্নে সচেতন এবং সমঝদার নাগরিকের মনে খেলা করে বিষাদ, হতাশা, আক্ষেপ।
পরিবেশের আলোচনায় এটাই চেনা ছক। তা সত্ত্বেও সংরক্ষণের চর্চা হবে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে। জল বাঁচানো এবং একবার ব্যবহার হয়ে যাওয়া জলের পুনর্ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। একবার ফিরে দেখা যাক যে সত্যিই কোনো অগ্রগতি ঘটেছে কিনা। সম্ভাবনার রূপোলি রেখাগুলো ক্ষীণ হলেও আর একবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক তার উপরে।
ধর্মের কল
বাতাসে ধর্মের কল নড়ে কিনা জানা নেই তবে কখনও কখনও ধর্মবেত্তারা পরিবেশের প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য সচেতনতা দেখিয়েছেন। সে দৃষ্টান্ত বিরল হলেও স্বাগত। অন্যান্য অনেক ধর্মের মতই ইসলাম ধর্মে ‘শুদ্ধ’ বা ‘পবিত্র’ হওয়ার বিধি আছে। এ কাজে জলের ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। বিপুল পরিমাণ মানুষ যখন নামাজ পড়ার ঠিক আগে হাত-পা ধুয়ে নেন তখন নিঃসন্দেহে ভালো পরিমাণ জল ব্যয় হয়। ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের করা আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় (Working Paper 37) উঠে এসেছে পাকিস্তানের প্রসঙ্গ। সেখানে ছিয়ানব্বই শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। শুক্রবারের বিশেষ নামাজে যখন লক্ষ লক্ষ মুসলমান হাত-পা ধোয়ার জন্য জল খোঁজেন তখন আগে একবার ব্যবহার করা জলের দিকে ফিরেও তাকান না কেউ। এই অভ্যাসের ব্যতিক্রম হয়ত আছে তবে নিয়মটার মূল কারণ রয়েছে শাস্ত্রের মধ্যেই, ফলে সবাই খোঁজেন বিশুদ্ধ জল। ব্যবহৃত জল দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজ হয় না। তাই যদি হয় তবে শুধু পাকিস্তান কেন, অন্যান্য মুসলমান-প্রধান দেশেও এভাবেই জল ব্যয় হবে। এখানে একমাত্র শাস্ত্রবেত্তাদের অনুশাসনই পারে পরিবর্তন আনতে। ১৯৭৯ সালে The Organization of Eminent Scholars of Saudi Arabia জল পুনর্ব্যবহারের কথাটা বিবেচনা করেন এবং ১৭ই এপ্রিল আল-মদিনা সংবাদপত্রে এক ফতোয়া জারি করেন এ সম্পর্কে। সেখানে বলা হয়, ব্যবহৃত জল যদি পরিষ্কার করা হয়ে থাকে এবং তার সঙ্গে যদি অব্যবহৃত বিশুদ্ধ জল যথেষ্ট পরিমাণে মেশানো হয় তাহলে ধর্মীয় কাজে তা ব্যবহার করতে কোনো বাধা নেই। এমন একটা সিদ্ধান্ত যে কেউ, কোথাও নিয়েছেন তা জানলেও ভালো লাগার কথা। কিন্তু এর কতটা প্রভাব পড়েছে বিশ্ব জুড়ে তার একটা ফল হাতে না পেলে ভালো লাগাটা ধরে রাখা একান্তই মুশকিল।
২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ভারতে শুরু হয়েছে স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প। অন্যান্য এলাকার সঙ্গে এখানে যুক্ত করা হয়েছে কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যেই আছে কাশ্মীরের মাতা বৈষ্ণোদেবী মন্দির। বছর জুড়ে বহু ভক্তের সমাগম হয় সেখানে, ইণ্ডিয়া টুডের তথ্য (ওয়েব সংস্করণ, ২রা অক্টোবর ২০১৮) বলছে যে সংখ্যাটা একাশি লক্ষের কাছাকাছি। সরকারি উদ্যোগে সম্প্রতি এখানে আরও একটা বাঁধানো রাস্তা এবং রোপওয়ে নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বহু মানুষ উপস্থিত হওয়ায় জলের ব্যবহারও এখানে হয় প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু মন্দিরের পরিচালন পর্ষদের দাবি, তারা এমন বহু পদক্ষেপ নিয়েছেন যার ফলে পঞ্চান্ন লক্ষ গ্যালন জল বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে প্রতি বছর। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় এমন প্রস্রাবাগার আছে যেখানে জল ব্যবহারের দরকার নেই, রয়েছে জল সংগ্রহের এ-টি-এম ইত্যাদি। পাশাপাশি ভক্তদের আসার পথের পাশে আছে ছ’টা দূষিত জল পরিশোধনের প্লান্ট। মন্দির কর্তৃপক্ষ তাদের কাজের জন্য সাফাগিরি পুরস্কার পেয়েছে ২০১৮ সালে, ইণ্ডিয়া টুডের কাছ থেকে। এখানে একবার অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে এই প্রেক্ষিতে ইণ্ডিয়া টুডে নিরপেক্ষ কোনো সংস্থা নয়, স্বচ্ছ ভারত মিশনে অ্যাম্বাসাডর হিসাবে মনোনীত তারা। সব কিছু জেনেও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো যায় জলের সঙ্কটের কথা ভেবে। তবে প্রকৃত সংরক্ষণ কতটা হয়েছে তা বুঝতে দক্ষ এবং নিরপেক্ষ কোনো সংস্থার সমীক্ষা জরুরি।
এইসব উদ্যোগ যা আপাতভাবে সদর্থক তা বিপুল পরিমাণ জলকে দ্রুত দূষিত করার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকাকে আড়াল করতে পারে না। সমীক্ষা না করেও গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ানো একজন মানুষ সহজে বলে দিতে পারেন, কত সহজে ধর্মীয় আচারের ফলে দূষিত হচ্ছে আমাদের প্রাণদায়িনী নদী। শিল্প কারখানার দূষণ আর নানা পৌরসভার বর্জ্যের সঙ্গে মিলে ধর্মীয় যাগযজ্ঞের ফেলে দেওয়া অবশেষ বা কোনো এক অলৌকিক ধামের উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেওয়া শবদেহ গঙ্গাকে আজ বিপজ্জনকভাবে দূষিত নদী করে তুলেছে। অন্য কোনো নদী যে ছাড় পেয়েছে তা একেবারেই নয়। দূষণের এই প্রবাহকে কি উল্টো দিকে বইয়ে দেওয়া যায়? পরিষ্কার জলের ব্যবহার ধার্মিক মানুষরা বন্ধ করে দেবেন তা আশা করবেন না কেউ কিন্তু জলের পুনর্ব্যবহারে শাস্ত্রজ্ঞানীদের অনুমোদন কি আশা করা যায় আরও ব্যাপকভাবে?
রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই পথে কিছু সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে। প্রতীকী হলেও উল্লেখ করা দরকার যে ২০১৯ সালের ৩১শে মে আফ্রিকার ইউনাইটেড রিলিজিয়নস ইনিশিয়েটিভ এবং অল আফ্রিকান কনফারেন্স অফ চার্চেস যোগ দেয় ইউ এন এনভায়রনমেন্টের সঙ্গে। সবাই মিলে ইন্টারফেইথ ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্ট ডে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ইউ এন এনভায়রনমেন্টের নীতি নির্ধারক বিভাগের অধিকর্তা গ্যারি লিউইস একটা খুব দরকারি কথা বলেন। তাঁর মন্তব্য, পৃথিবীতে যত বিদ্যালয় আছে তার অর্ধেক ধর্মবিশ্বাসীদের দ্বারা চালিত। ফলে অন্যান্য অনেক জিনিসের মত পৃথিবীর পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে সেগুলো শিক্ষিত করে শিশুদের। এখানে দৃষ্টিভঙ্গীর একটা পরিবর্তন আনতে পারলে সেটা হবে খুব কার্যকর! ২০১৯ সালে পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা ছিল বায়ুদূষণকে ঘিরে কিন্তু ধর্মের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারলে সেটা জলের ক্ষেত্রেও সদর্থক প্রভাব ফেলবে।
ট্রিটমেন্ট প্লান্টই হোক আর জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করানো কোনো বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রই হোক, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা জল মানুষ ব্যবহার করবে কিনা তা তাদের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যাণ্ডের টুউম্বাতে জল পুনর্ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা তৈরি হলে বাধা দিয়েছিল স্থানীয় মানুষজন। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে সেই এলাকায় খরা চলেছে, জলের মারাত্মক সঙ্কট দেখেছে মানুষ। তাই ইঞ্জিনীয়ারদের ভাবনা অনুযায়ী মাত্র পঁচিশ শতাংশ জল পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করলে সেটাই হত স্বাভাবিক। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করল যে তারা আসলে নোংরা জল পান করতে যাচ্ছে। তাই সবাই ভোট দিলেন বিপক্ষে। অথচ বিশ্ব জুড়ে জল পুনর্ব্যবহারের সফল উদাহরণ নেই তা তো নয়। ব্যবহৃত জল পরিশোধন করে সাড়ে তিন লক্ষ অধিবাসীকে পানীয় হিসাবে সরবরাহ করা হয় নামিবিয়ার উইণ্ডহোক শহরে। বিশ্বের অন্যতম শুষ্ক দেশ নামিবিয়া। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত আড়াইশো মিলিমিটার। প্রচণ্ড তাপের কারণে তার তিরাশি শতাংশ সহজে বাষ্পীভূত হয়। তাই জল পুনর্ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয় ১৯৬৮ সালে। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর ধরে জল শোধন করে সেটাকে পানীয় হিসাবে ব্যবহার করছে উইণ্ডহোকের মানুষ। ধর্মীয় বিশ্বাস বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। এর সমতুল্য আর একটা মাত্র উদাহরণ আছে পৃথিবীতে। সেটা একটা নগর-রাষ্ট্র – সিঙ্গাপুর।
কৃষিতে জল পুনর্ব্যবহার
জলের সঙ্কট যেখানে, নিয়মিতভাবে পরিষ্কার, মিষ্টি জল পাওয়া যেখানে সত্যিই কঠিন সেখানে অস্তিত্ব বাঁচাতে চাষীরা যে জল পুনর্ব্যবহার করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু ব্যবহৃত জলের ধারায় মিশে থাকে বহু জিনিস যা মানুষের শরীরে সরাসরি ঢুকলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। তাই দরকার শোধন। কী হবে শোধনের লক্ষ্য? বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সুইজারল্যাণ্ডের ইন্টারন্যাশনাল রেফারেন্স সেন্টার ফর ওয়েস্ট ডিসপোজাল ১৯৮৫ সালে এক সম্মেলন করে এ ব্যাপারে নির্দেশিকা তৈরি করেন। তারই ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তৈরি করে সুপারিশ। যেসব শস্য সরাসরি মানুষ গ্রহণ করে না যেমন তুলো, সূর্যমুখী ইত্যাদি বা মানুষের গ্রহণের আগে যেগুলো কোনো একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায় যেমন গম, বার্লি ইত্যাদি – তাদের ক্ষেত্রে নিয়ম হল এই যে পুনর্ব্যবহারের জন্য নেওয়া জলের প্রতি লিটারে নিমাটোডের একটা ডিমের বেশি থাকবে না। এই নিমাটোড বলতে বোঝানো হয়েছে নানা রকমের কৃমি (roundworm, hookworm, whipworm). অন্যান্য আরও কিছু পরিবেশের সঙ্গে মানুষের অন্ত্রে বাসা বেঁধে থাকে এরা। ডিম থেকে নতুন কৃমি তৈরি হয়ে পৌষ্টিক তন্ত্র প্লাবিত করতে এদের বিশেষ অসুবিধে হয় না। এবার আসা যাক সেইসব শস্যে যেগুলো মানুষ গ্রহণ করে সরাসরি। শসা বা লেটুস পাতা যেগুলো আমরা কাঁচা খাই সেগুলোও থাকবে এই তালিকায়। এগুলোর ক্ষেত্রে নিমাটোডের ডিম সংক্রান্ত বিধি তো থাকবেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষের মল থেকে আসা কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়া সংক্রান্ত একটা বিধি। প্রতি হাজার মিলিমিটার পুনর্ব্যবহারযোগ্য জলে কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা যেন এক হাজার না ছাড়ায়।
আবারও প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিধি কারা মানতে পারছে? না মানার বিপদ বোঝাতে বিদেশের উদাহরণ নিয়ে চর্চা করা যাক। অকুস্থল মেক্সিকো, উচ্চারণ বিশেজ্ঞদের জন্য মেহিকো। সেখানেই রয়েছে মেজকুইটাল উপত্যকা।অন্যান্য বহু জায়গার মতই হুড়মুড় করে উন্নয়ন হয়েছে সেখানে, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পড়েছে টান, মানুষ গিজগিজ করা শহরে জল ব্যবহারে থাকে নি কোন নিয়ন্ত্রণ। চাষীরা পড়ল ফাঁপরে, তাদের জলের উৎসে হাত দিয়েছে উন্নয়ন ব্যবসায়ীরা। এবার তারা নিল সহজ পথটা, ব্যবহৃত জল কোনো শুদ্ধিকরণ ছাড়াই সোজা চালান করে দিল চাষের ক্ষেতে। বহু দশক ধরে এই প্রক্রিয়া চলেছে, এমনভাবেই শস্য উৎপন্ন হয়ে এসেছে বাজারে। কিন্তু এর মাশুল গুনতে হয়েছে উপভোক্তাদের। ঘরে-ঘরে পেটের রোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সার দেখা দিয়েছে নিয়ম করে। পরিসংখ্যান বলছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার মধ্যে কিডনি ক্যান্সারের সবথেকে বেশি উদাহরণ রয়েছে মেজকুইটাল উপত্যকায়। একইভাবে বাচ্চাদের পেটে ক্রিমি বা জিয়ার্ডিয়ার সংক্রমণের ক্ষেত্রেও এগিয়ে এই উপত্যকা।
নানা সমীক্ষা বলছে, পৃথিবীতে মানুষ যেভাবে বাড়ছে তাতে খাদ্যের যোগান দিতে চাষের ক্ষেতে জলের পুনর্ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এইসব সমীক্ষার নির্যাস হল, এখনই পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদনের জন্য নির্ধারিত কৃষিক্ষেতের দশ শতাংশ জলের পুনর্ব্যবহার করে। প্রায় পঞ্চাশটা দেশে এমন চল রয়েছে। সঙ্কটের কালে এমনভাবে জল ব্যবহারের ঝোঁক স্বাগত কিন্তু বিপদের কথা ভোলা যাবে না। উন্নত দেশে জল শোধনে অনেক যত্ন নেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু তাতেও মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি চলে যায় না। অনেক জায়গায় পরিশোধন করা জলে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়ার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিশৃঙ্খল সামাজিক অভ্যাসকে দুষছেন সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাকারীরা। কিন্তু দূষিত জল ব্যবহারকে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বা তার শাখা সংগঠনগুলোর প্রকাশিত বিবৃতিতে চাষের কাজে জল পুনর্ব্যবহারের আবেদন যতটা থাকে, বিপদ সম্পর্কে সাবধানবাণীর উপস্থিতি ততটা চোখে পড়ে না। এটা কিন্তু আরও বিপজ্জনক।
বাস্তব বুদ্ধি, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরার প্রাদুর্ভাব ঘটছে আরও বেশি সংখ্যায়। ২০১৮ সালে ইউরোপিয়ান কমিশন প্রকাশিত দলিলে বলা হয়েছে ১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সে মহাদেশে খরার ঘটনা বেড়েছে কুড়ি শতাংশ। শুধু ২০১৭ সালের খরায় ইতালিতে কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতি হয় দুশো কোটি ইউরোর মত। এই প্রবণতা বাড়বে বৈ কমবে না। পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে চিন্তিত এতগুলো ইউরোপীয় দেশ নিয়ে গড়া গোষ্ঠী। দলিলে স্পষ্ট আবেদন, ইউরোপীয় ভূখণ্ডের জলসম্পদ আরও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের জন্য। তবে জলের ব্যবহার কমালেই সুরাহা হবে না, জলের পুনর্ব্যবহার আশু প্রয়োজন। আবারও মূল ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে চাষের ক্ষেতকে। লবণমুক্ত করে সমুদ্রের জল ব্যবহার করা বা অন্য এলাকা থেকে পরিচ্ছন্ন জল আনার সঙ্গে তুলনা করলে জলের পুনর্ব্যবহার অনেক ভালো। তাতে গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ হয় কম, পরিবেশের ক্ষতিও অনেকটাই কম হয়। পুনর্ব্যবহার হলেই যে জলের সঙ্কট কেটে যাবে না তা মেনে নিয়েও কমিশন বলছে, যতটা পারা যায় তার সিকিভাগ কাজও হয় নি পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
এবার নিজেদের গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় এসেছে কমিশন। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া জলের পুনর্ব্যবহারের খরচ বাড়বে। এক-একটা নদীপথ ঘুরেছে বহু দেশের মধ্যে দিয়ে। দানিয়ুব বয়ে গিয়েছে উনিশটা দেশের সীমানার ভেতর দিয়ে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা তাই বাধ্যতামূলক। ফলে কমিশন চাইছে একটা মজবুত কাঠামো, একটা কনভেনশন। তবে প্রতিকূলতায় ডুবে নেই কমিশন, এটাও উল্লিখিত হয়েছে দলিলে। শিক্ষার কারণেই হোক আর পারস্পরিক বন্ধনের ফলেই ঘটুক, জল পুনর্ব্যবহারের সুফল নিয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণা রয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। এখান থেকেই ভিত্তিটাকে দৃঢ় করার পথ খুঁজেছে কমিশন।
এমন বাস্তবানুগ পরিকল্পনার আগ্রহ থাকলে সুফলের আশা করা যায় বোধহয়। তা না করে এক দেশ অন্য দেশের প্রতি সারাক্ষণ ‘যুদ্ধং দেহি’ হয়ে থাকলে জল পুনর্ব্যবহারের ভাবনা অলীক ছাড়া কিছু হবে না।
Add Comments