আর্থিক সঙ্কট কী? বা কাকে বলে ? সে নিয়ে অল্পবিস্তর আমরা প্রত্যেকেই ওয়াকিবহাল। তবে তার মধ্যে বিস্তর রকমফের বর্তমান, সে নিয়ে দুচার কথা স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে। মুদ্রার ঘাটতি, স্টকমার্কেটে ধস, বড়সড় আর্থিক বিচ্যুতি, ঋণখেলাপি-দের সৃষ্ট সমস্যা অথবা ফাটকামূলক আর্থিক বুদ্বুদ-বিস্ফোরণের (স্পেকুলেটিভক্রাইসিস) খবর, সংবাদপত্রের মারফৎ আমরা জানতে পারি। ২০০৮-এ ঘটে যাওয়া বিশ্বব্যাপী আর্থিকসংকট (Global Financial Crisis) এবং বিখ্যাত বিদেশীলগ্নি সংস্থা ও ব্যাঙ্ক লেম্যানব্রাদার্সের পতনের অভিঘাত সবটা না বুঝলেও, তার গুরুত্ব বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয়নি কারোর। এই সম্পূর্ণ বিপর্যয়ের নেপথ্যে ছিল মানুষের বিভ্রম, আর ছিল একদলের সেইবিভ্রমকে উসকে দিয়ে ফাটকাবাজারে আর্থিক লাভের বুদ্বুদ তৈরির সাফল্য। সহজভাবে বলতে গেলে একটি জিনিসের বাজারে যা দ্রব্যমূল্য রাতারাতি তা থেকে দ্বিগুণ লাভের হিসেব অপরকে দেখানো, সেই মিথ্যের সাহায্যে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া এবং সেই বিভ্রমকে বিরাট আকার দিয়ে লগ্নিকারী-দের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার অপর নাম “দূরকল্পী বুদ্বুদ”। প্রকৃত সত্য যখন সামনে এসে পড়ে তখন নিমেষেই ভেঙে যায় বিভ্রম, বুদ্বুদ ফেটে গিয়ে কপর্দকশূন্য সাধারণ মানুষ ও লগ্নিকারী-দের জন্য রেখে যায় বিপুল ঋণের বোঝা !
ছবি ১; ১৬০৬ এ আঁকা একটি তৈলচিত্রে প্রতিকৃতির পাশাপাশি টিউলিপ বাল্বের প্রাধান্য চোখে পড়ে সহজেই।
অর্থনীতি-র ইতিহাসে এমন ঘটনা অবশ্য নতুন নয় — এর প্রথম আবির্ভাব ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে; তখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সুদূর নেদারল্যান্ডস-এ টিউলিপ ফুলের রপ্তানি হত। এ ফুল আগে তেমন সমাদৃত ছিল না ডাচ-দের কাছে। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দী-র শেষ টিউলিপ ক্রমেই সম্ভ্রমের প্রতীকরূপে গন্য হতে লাগল ওলন্দাজ-দের কাছে। চিমনি সারাইওয়ালা থেকে অভিজাত বিত্তবান, টিউলিপ-চক্রে আবর্তিত হতে বাদ গেলেন না কেউ-ই। একই টিউলিপ ফুল দিনে দশবার করে বিকিয়ে যেতে লাগল ,আক্ষরিক অর্থে নয় বরং টিউলিপ ‘future’-এর লেনদেনই ঘটেছিল একরকম – একটা সময়ে দেখা গেল রাজা-প্রজা কেউই আর টিউলিপ নিয়ে আগ্রহী নয়, সকলেরই লক্ষ্য মুনাফা! মানুষের লোভ সীমা ছাড়াল, বাড়ি বাগানের দামে বিক্রি হতে লাগল টিউলিপ! ১৬৩৭ সনে একটি টিউলিপ বাল্ব ৩০০০ গিল্ডার্সেও (তৎকালীন ওলন্দাজী মুদ্রা) বিকিয়েছে– ২০০৮-এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার বাজারে যার দাম হত ৩১,০০০ ইউরো-র সমান! কালান্তক ব্যাধি প্লেগের প্রাদুর্ভাব ও যুদ্ধের আবহে ঘটল বিপর্যয়! জনগণ বিষয়-আশয় বেচেও টিউলিপ কিনতে মরিয়া, ফাটকাবাজদের ভূমিকায় অবতীর্ণ ফুল-বিক্রেতারা; এমন সময় কিছু নবাগত বিক্রেতার নির্বুদ্ধিতায় আসল ছবিটা বেরিয়ে এল; বিভ্রমের বুদ্বুদ সশব্দে বিনষ্ট! ফেব্রুয়ারী ১৬৩৭-এ রাতারাতি ফকির বনে যাওয়া বহু লগ্নিকারী ও ব্যবসায়ী ক্যানালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলেন। ভয়াবহ অবস্থা সামাল দিতে সরকার পদক্ষেপ নিলেন বটে, তবে ততদিনে হল্যান্ডের অবস্থা শোচনীয় !
ছবি ২; ১৬৪০ সালে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র : বাঁদরদের টিউলিপের বেচাকেনা করতে দেখা যাচ্ছে।
আদ্দিকালের এই বিপর্যয়ের কাহিনী একাধিক বইয়ে স্থান পেয়েছে বিশ্বের সর্বপ্রথম দূরকল্পী আর্থিক বুদ্বুদ হিসেবে! অর্থনীতির জগতে ‘টিউলিপম্যানিয়া’ পাগলামির নামান্তর। তবে এ ঘটনার মধ্যে সত্যি মিথ্যের মিশেলটা বড় কম নয় , অন্তত বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপিকা অ্যানি গোল্ডগার তেমনটাই দাবী করেছেন। Tulipmania: Money, Honor and Knowledge বইটির কাজে তাঁর অনেকটা সময় কেটেছিল ওলন্দাজ মহাফেজখানাগুলিতে। সেই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে উঠে আসে একটা অন্য গল্প। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ থেকে হল্যান্ডে টিউলিপের জয়যাত্রা শুরু। নিজেদের সুশিক্ষা, আভিজাত্য, সুরুচির বাহ্যিক প্রচারের জন্য অনেকেই বেছে নিলেন এই বিলাসিতার বস্তুটি। সেকালের টিউলিপ-রসিকদের মধ্যে অনেক ওলন্দাজ শিল্পী, চিত্র সংগ্রাহকও ছিলেন। টিউলিপের দর বাড়ল সহজেই, কারণ আর পাঁচটা সাধারণ ফুলের মত সহজে এর চাষ করা যেত না। এতদসত্ত্বেও টিউলিপের বেচাকেনা কখনই এমন ভয়াবহ আকৃতি নেয়নি, বাজারে বা ট্যাভার্নে মোটের উপর নিরুপদ্রবেই এর বিনিময় হত, এবং স্টক এক্সচেঞ্জে তা নিয়ে অসুবিধা হয়নি কখনো। প্লেগের মত মহামারী-র মধ্যে মানুষ হামলে পড়ে টিউলিপ কিনছে এ বিষয়টিও অনেকাংশে আরোপিত বলে দাবী করেছেন অ্যানি — তাঁর গবেষণা অনুযায়ী ১৬৩৬ সালে প্লেগের প্রাদুর্ভাব শুরু,অথচ টিউলিপের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছিল ১৬৩৭ এর জানুয়ারী তে! তখন রোগের প্রকোপ কমে এসেছে। বিপুল অর্থব্যয় করে ফুল কেনার বিলাসিতা সে যুগেও হাতেগোনা মানুষই করতে সক্ষম ছিলেন, তৎকালীন নথি অনুযায়ী মোট ৩৭ জন ব্যাক্তি ছিলেন সেই তালিকায়, তবে তারাও একটি ফুলের জন্য সর্বোচ্চ ৩০০ গিল্ডার অবধি খরচ করেছেন! এখানেই শেষ নয় , টিউলিপেরও রকমফের ছিল, সুলভ মুল্যে পাওয়ার মত ফুল ছিল সে যুগেও। কাজেই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে অনভিজ্ঞ বিক্রেতাদের নির্বুদ্ধিতাকে চিহ্নিত করা হলেও আসল ত্রুটি ছিল ভিন্ন। ১৬৩৭-এর প্রথম পাঁচ সপ্তাহের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও অধিক সরবরাহের ফলে মানুষের মনে এক অজানা আশঙ্কা দানা বেঁধেছিল। আসলে ফুলের যোগান তেমন ছিল না সেসময়, মে-জুন মাসে ফুল ফুটলে তবেই আর্থিক লেনদেন সম্পূর্ণ হত! সুতরাং ফেব্রুয়ারী-র আর্থিক সঙ্কটে যাদের ক্ষতি হয়েছিল তার সিংহভাগই ছিল ধারণাগত! এমনকী ক্যানালে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাগুলিও পরবর্তী-তে মানুষের নাটকীয় কল্পনার ফসল। একথা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে টিউলিপ ব্যাবসায়ীরা মোটেই তেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েননি, যারা প্রাপ্য অর্থের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন এক তারা বাদে বাকিদের অবস্থা ছিল আগের মতই। টিউলিপ ব্যাবসায় যারা সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলে দাবী করা হয়, আসলে তাঁরা তা হয়েছিলেন মুষ্টিমেয় কপর্দকহীন মানুষের বাড়ি , সম্পত্তি কেনার দরুন – যার যোগসূত্র এর সঙ্গে সামান্যই। সরকারের ভুমিকা নিয়েও অতিকথন বর্তমান , আদতে এই সমস্যার মুখোমুখি সরকারকে আদৌ হতে হয়নি!
এতকিছুর পর, একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে, বিপুল কল্পনায় পরিপুষ্ট এ ঘটনা এতখানি মান্যতা পেল কিভাবে? এর জন্য বোধহয় ১৬৩৭ এ ওলন্দাজ-দের গান আর বিলি করা মজার হ্যান্ডবিলই দায়ী। ব্যবসায়ীদের ব্যাঙ্গ করতে লেখা এসব গান, পুস্তিকা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান রচয়িতাগণ বিপুলভাবে নিজেদের রচনায় ব্যবহার করেন। বেষ্টসেলার সেসব বই ইংরাজি-তে অনূদিত হয়ে বৃহত্তর পাঠকসমাজে সমাদর লাভ করে। ফলস্বরূপ তথ্যগুলির স্বীকৃতি লাভ !
চার্লস ম্যাকে’র “ Extraordinary Popular Decisions and the Madness of Crowds (১৮৪১) দ্রষ্টব্য। যুগকালের বিভেদ মুছে কল্পনা বাস্তবের অদ্ভুত মিশেলে সৃষ্ট এই ‘টিউলিপম্যানিয়া’র সবচেয়ে বড় পরিচয় এক মূর্তিমান হুঁশিয়ারি হিসেবে – যা কয়েকশো বছরের অগনিত লগ্নিকারী-দের কাছে এক অলিখিত প্রবাদবাক্য –বিপর্যয়ের সাবধানবাণী !
তথ্যসূত্র : ১)Goldgar,Anne. , Tulipmania: An Overblown Crisis? , History Today, 17th April 2018. ২) Sooke, Alastair. , Tulipmania: The flowers that cost more than houses, 3rd May 2016. ৩) Wastulipmania irrational? , Economic Times, October 4th, 2013
Add Comments