ডারউইনের ফিঞ্চ ও তাদের চঞ্চুর বিবর্তন

৩ জানুয়ারী, ২০১৮

গ্যালাপাগোস ও কোকোস দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা, ডারউইন যাদের চিনেছিলেন, সেই ফিঞ্চ-পাখি প্রজাত্যায়ন এবং অভিযোজিত বিবর্তনের এক প্রাঞ্জল উদাহরণ। উপসালা এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি দল, এই ফিঞ্চ প্রজাতীয় পাখির বিবর্তনের ইতিহাসে আলোকপাত করে দেখিয়েছেন, কীভাবে চিহ্নিত একটি জিন তাদের চঞ্চুর গঠনে প্রকরণ তৈরি করেছে। ডারউইনের ২০৬তম জন্মবার্ষিকীর ঠিক আগের দিন ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্রটি।

অভিব্যক্ত বিকিরণের প্রকৃষ্ট এক সনাতন উদাহরণ ডারউইনের এই ফিঞ্চ-পাখি। আজ থেকে দু’মিলিয়ন বছর আগে তাদের আদি পূর্বপুরুষ গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে ঘাঁটি গাড়ে। সময় সমুদ্র-নদীর জলের মতোই বয়েছে, আর সেই স্রোতে দৈহিক গঠন, ঠোঁটের আকার, গানের ধরণ ও শিশুপাখিকে খাওয়ানোর নিরিখে প্রায় ১৫টি ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে ডারউইনের সেই ফিঞ্চের। পতঙ্গ, বীজ বা ক্যাকটাসের মকরন্দ থেকে শুরু করে ইগুয়ানাসের রক্ত – খাদ্যের যোগানের উপর ভিত্তি করে এই বিভিন্ন প্রজাতিগুলির মধ্যে শারীরিক পরিমাপ ও ঠোঁটের আকার অভিযোজিত হয়েছে, এবং সমস্তটাই ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ন্ত্রিত।

পি.এইচ.ডি ছাত্র সংগীত লামিছানে এই গবেষণাপত্রের মুখ্য ব্যক্তি। তাঁর মতে, ডারউইনের ফিঞ্চ পাখিদের মধ্যে ভিন্ন প্রজাতি থেকে ১২০টি পাখিকে সারিবদ্ধভাবে পরীক্ষা করা হয়, এবং দুটি অতি নিবিড়সম্পর্কযুক্ত প্রজাতিকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় সূক্ষ্ম বিবর্তনীয় ইতিহাস জানার জন্য। প্রত্যেকটি প্রজাতিভুক্ত একাধিক ফিঞ্চ পাখির বৈশিষ্ট্য যেমন বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তেমনই ছয়টি বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ থেকে আরও কিছু প্রজাতিকে গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করা হয় দ্বীপের ভেতরে ও বাইরে বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানে।

এই ফিঞ্চদের ক্ষেত্রে, আন্তঃপ্রজাতি জিনের যে প্রবাহ, সেটাই বিবর্তনের দলিলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে – গবেষণার গভীর থেকে উঠে আসছে এমনই তথ্য। গাছে বা মাটিতে থাকা ফিঞ্চের সাধারণ পূর্বজের সাথে ওয়ার্বলার ফিঞ্চের মিলিয়ন বৎসর প্রাচীন সুস্পষ্ট সংকর-সম্পর্কও খুঁজে পেয়েছেন এই গবেষক দল।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার ও রোসম্যারী গ্রান্ট, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করার পর, ডারউইনের এই ফিঞ্চ পাখিদের জীববৈজ্ঞানিক বিষয়ে এই মুহূর্তে সর্বাধিক ভরসাযোগ্য দুই ব্যক্তি। তাঁরা জানাচ্ছেন, “ গ্যালাপাগোসের বহু ফিঞ্চ প্রজাতির মধ্যে আমরা সংকর গুণাবলীর স্পষ্ট ছাপ দেখেছি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি বিবর্তনীয় প্রভাবে এই সংকর-প্রক্রিয়াটি অব্যক্তই রয়ে গেছে।” পিটার গ্রান্ট যোগ করলেন, জিনগত বিবিধতা বজায় রাখার সংকল্পেই এই আন্তঃপ্রজাতি সংকরায়ন, মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে ফিঞ্চের বিবর্তনে – এ কথা নিশ্চিন্তেই বলা চলে।

মূলত চঞ্চুর আকার ও আকৃতিতেই অভিনব ফেনোটাইপিক ভেদ লক্ষ্য করা যায় ফিঞ্চ প্রজাতীয় পাখিদের মধ্যে। ভয়েজ অফ দ্য বিগেল বইতে ডারউইন যেমনটা বলছেন – ইয়োরোপীয় হোওফিঞ্চ, চ্যাফিঞ্চ বা ওয়ার্বলার পাখির সাথে এই গ্যালাপাগসীয় ফিঞ্চ পাখির বৈচিত্র্যের তুলনা , দ্বীপের পাখিটি জীববিভিন্নতায় তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। ভোঁতা এবং ধারালো ঠোঁটের দুটি করে ফিঞ্চ প্রজাতিকে নিয়ে গবেষণায় প্রকরণের নেপথ্যে কাজ করা জিনগত ভিত্তিটিকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই বৈপরীত্যের উপাদানগুলি নিয়ন্ত্রণ করে জিনোমের ১৫টি অঞ্চল এবং এই জিনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬টি জিন মুখ-করোটির গঠনপার্থক্যের হোতা।

উপসালা ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর ল্যিফ অ্যান্ডারসন বলছেন, এ.এল.এক্স ১ জিনের জেনেটিক প্রকরণের সাথেই ডারউইনের ফিঞ্চ প্রজাতির ঠোঁটের গঠন সম্পর্কিত, শুধুমাত্র আন্তঃপ্রজাতি তুলনার ক্ষেত্রেই নয়, মাঝারি উচ্চতার জমিতে থাকা ফিঞ্চ পাখির দেহেও – এটাই সবচেয়ে উৎসাহব্যঞ্জক ও গুরুত্ববাহী সন্ধান।

যেহেতু আমরা আগেই দেখেছিলাম মাঝারী উচ্চতার জমিতে বসবাসকারী ফিঞ্চদের চঞ্চুর আকৃতি, পরিবেশের পরিবর্তন মোকাবিলায় এলোপাথাড়ি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। এখন নতুনভাবে আমরা জানলাম এই গুরুত্বপূর্ণ এ.এল.এক্স ১ জিনের ভিন্ন ভেদসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে সংকরায়ন প্রক্রিয়া – এমনই বলছেন রোসম্যারী গ্রান্ট।

মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহে মুখকরোটির ক্রমগঠনে বেশ প্রামাণিক ভূমিকা এ.এল.এক্স ১ জিন তার প্রতিলিপিকরণের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে। এবং অভিব্যক্তির দরুন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা এই জিনের প্রভাবে জন্মগত ত্রুটিবিচ্যুতি আসতে পারে মানবদেহে, যেমন নাসাগ্রে অবাঞ্ছিত মাংসপিণ্ডের উদ্ভব।

ল্যিফ অ্যান্ডারসন মন্তব্য করেছেন, সাধারণ বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট জিনের খুব মৃদু অভিব্যক্তিও ফেনোটাইপিক বিবর্তনের পথে হাঁটতে পারে, কৌতূহলের উদ্রেক নিশ্চিতরূপেই হয় সেক্ষেত্রে। এই এ.এল.এক্স ১ জিনের ক্ষণিক লীলাতেই যে মানুষের মুখমণ্ডলের এই বৈচিত্র্য, অভিব্যক্তির এই অনুসন্ধানও যদি কোনোদিন হয়, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই – বলে বক্তব্য শেষ করেছেন প্রোফেসর অ্যান্ডারসন।

তথ্যসূত্র : উপসালা ইউনিভার্সিটি, সুইডেন

Add Comments