মহাকাশ নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহল সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে। মহাকাশ গবেষণা এবং তার প্রয়োজনে মহাকাশ অভিযানের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । বিগত সত্তর বছর ধরে একের পর এক মহাকাশ অভিযানের উদ্যোগ এর সত্যতাকে তুলে ধরে। যদিও মহাকাশ অভিযানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু মহলে মতভেদ আছে, তবুও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, গবেষণা, মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন, উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষায় এর প্রভাব অনস্বীকার্য। পরিবেশ রক্ষায় তথা পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত অসুবিধার উপযুক্ত সমাধান খুঁজতে মহাকাশ গবেষণা আমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু ঠান্ডাযুদ্ধের পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকারের কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করার ফলে আমরা আজ এক নতুন ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন। আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে পৃথিবী অব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি যেমন- কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল প্রভৃতি আবর্জনার স্তুপে ভরে যাচ্ছে , যাকে আমরা ই-ওয়েস্ট বলি ।এবার সেই একই সমস্যা মহাকাশেও। একবার চোখ বন্ধ করুন ও ভাবুন- কীভাবে পৃথিবী আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে পাঠানো মহাকাশযান ও কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা।
বেশ কয়েক দশক আগেও মানুষের ধারণা ছিল মহাকাশে স্থানের অভাব নেই। কিন্তু ঝাঁকঝাঁক মহাকাশ অভিযানের পরে এই ধারণা প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আমরা জানি পৃথিবী থেকে পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে তাদের কার্যকারিতা অনুসারে নির্দিষ্ট কক্ষ পথে স্থাপন করতে হয় । তাই দিনদিন বিভিন্ন কক্ষপথে উপগ্রহ সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে সেইখানে হয়তো স্থান সংকুলান সম্ভব হবে না। এছাড়া এইসব প্রেরিত মহাকাশযান, রকেট, তাদের জ্বালানি কক্ষ, কৃত্রিম উপগ্রহ ও তার বিভিন্ন যন্ত্রপাতির অংশগুলি অকেজো হয়ে যাবার পরও সেইসব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করতে থাকে। কিছু যন্ত্রপাতি, জ্বালানিকক্ষ, উপগ্রহের অংশবিশেষ ক্রমশ ছোট ছোট টুকরো হতে থাকে এবং নিজেদের মধ্যে ধাক্কায় ধূলিকণার স্তূপ বা মেঘ সৃষ্টি করে। পৃথিবীর নিকটবর্তী কক্ষপথে এইসব ধূলিকণার স্তূপ বা মেঘ পরিভ্রমণ করতে থাকে। এইসব গুলিকে মহাকাশের আবর্জনা বা জাংক বলা হয়। এই সব স্পেস জাংক আসলে একসময়কার কার্যকরী মহাকাশযান, রকেট বা কৃত্রিম উপগ্রহের অংশবিশেষ। তাই যত বেশি বেশি মহাকাশে আমরা মহাকাশ যান বা উপগ্রহ পাঠাব, তত বেশি স্পেস জাংক সৃষ্টির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে । এরা নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে । এদের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি লক্ষ করা যায় পৃথিবীর নিম্ন বা নিকটবর্তী কক্ষপথে। যদিও স্পেসজাংক গুলির আকৃতি ক্ষুদ্র, কিন্তু এদের গতি বেশ বেশি হওয়ার কারণে এদের ভরবেগ বেশি হয়। ফলে এরা অন্যান্য কার্যকরী মহাকাশযান ও উপগ্রহের বেশি ক্ষতি করতে পারে। অত্যন্ত বেশি গতিবেগের দরুন এরা বড়োবড়ো মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহকে ধ্বংস বা পুরোপুরি অকেজো করে দিতে পারে। আকারে বড়ো স্পেসজাংক গুলি আবার পৃথিবীর দিকে চলে আসতে পারে ও বিপর্যয় ঘটাতেপারে। সমস্যাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্পেসস্টেশনকে তিনবার স্থান পরিবর্তন করাতে হয়েছে, আসন্ন সংঘর্ষের হাত থেকে বাঁচাতে । এখন থেকেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানের পথে এই সমস্যা প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ইউরোপিয়ান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে মহাকাশ অভিযানের শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত ৫০০০ এরও বেশি মহাকাশ অভিযানের মাধ্যমে প্রায় ২৩০০০- এর বেশি কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র ১২০০টি কার্যকরী অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ ৯৪% মহাকাশের আবর্জনাতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল এদের বেশিরভাগ অংশকে পৃথিবী থেকে চিহ্নিত করা একপ্রকার অসম্ভব। বিভিন্ন গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে জানা গেছে, এক মিলিমিটার থেকে এক সেন্টিমিটার ব্যাস যুক্ত ক্ষুদ্র স্পেস জাংকের সংখ্যা প্রায় ১৬.৬ কোটি এবং ১০সেমির উপর ব্যাসযুক্ত স্পেস জাংকের সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০। এছাড়া বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা পৃথিবীর কক্ষপথে প্রায় ৪২,০০০ স্পেসজাংককে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলি প্রতি ঘন্টায় ৫৬০০০কিমি ঘোরার ফলে প্রচুর ভরবেগ অর্জন করে এবং তার ফলে এদের ধ্বংস করার ক্ষমতা অত্যন্ত বেড়ে যায়। এইভাবে স্পেস জাংকগুলি অন্যান্য কার্যকরী মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহকে ধ্বংস করে উত্তরোতর স্পেসজাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এইভাবে স্পেসজাংকের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপাওয়ার ঘটনাকে কেসলার এফেক্ট বলা হয়ে থাকে।
স্পেসজাংকের পূর্বে উল্লিখিত উৎস গুলি ছাড়া ও অন্য কিছু উৎসেরও সন্ধান পাওয়া যায়। অনেক সময় মহাকাশ অভিযানের সময় রকেটের জ্বালানি কক্ষে কিছু অতিরিক্ত জ্বালানি নিয়ে যাওয়া হয়, সেই অব্যবহৃত জ্বালানির বিস্ফোরণের ফলেও স্পেসজাংক সৃষ্টি হয়। এছাড়া মহাকাশচারীদের ব্যবহৃত ক্যামেরা, ব্যাগ, পোশাকের টুকরো, গ্লাভস থেকেও স্পেসজাংক সৃষ্টি হয়। যেমন- STS-116 মহাকাশযান থেকে সুনীতা উইলিয়ামের ক্যামেরাটি হারিয়ে যায়। আবার অনেকসময় ব্যর্থ উৎক্ষেপণের ফলে রকেট বা উপগ্রহগুলি সঠিক কক্ষপথে স্থাপিত হয়না । এগুলি অন্য কার্যকরী যানের সাথে ধাক্কায় স্পেসজাংক সৃষ্টি করে। আজকাল আবার বিভিন্ন দেশের মধ্যে অস্ত্রপরীক্ষার একটি ঠান্ডা লড়াই চলছে। প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত অ্যান্টিস্যাটেলাইট মিসাইল মহাকাশে পরীক্ষা করার ফলে মহাকাশে জঞ্জালের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্পেসজাংকের ফলে বিভিন্ন সক্রিয় মহাকাশযান ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৯৮১সালে কসমস-১২৭৫ ধ্বংস হয়। ফ্রান্সের CERISE, ১৯৯৬ সালে অ্যারিনের ধ্বংসাবশেষের ধাক্কায় অকেজো হয়ে যায়। রাশিয়ার মহাকাশ যান AM11 স্পেসজাংকের ধাক্কায় পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এইসবের ফলে প্রভূত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সবচেয়ে বড়ো ধ্বংসের ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারিতে, যখন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা উপগ্রহ কসমস-২২৫১, ইরিডিয়াম- ৩৩ নামক এক মার্কিন মহাকাশযানের সাথে সংঘর্ষ ঘটায় এবং এর ফলে প্রায় ২০০০টি টুকরো মহাকাশে ভাসতে থাকে। এছাড়া বহুক্ষেত্রে অল্পের জন্য বড়ো দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তিনবার ইন্টারন্যাশনাল স্পেসস্টেশনের স্থান পরিবর্তন। এছাড়া ২০১৩ সালে ENVISAT নামক এক উপগ্রহ উপযুক্ত পথ পরিবর্তন করে এবং তার উপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে যায়। সেটি এখনও ১৫০বছর কক্ষপথে ঘুরবে এবং তারপর পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে জ্বলে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই উপগ্রহ পরবর্তী ১৫০ বছর ধরে অন্যান্য উপগ্রহের কাছে এক বড়ো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই মহাকাশ অভিযান ও উপগ্রহ নিয়ন্ত্রণ এক সমূহ বিপদের সম্মুখীন। সময় নষ্ট না করে আমাদের এই মুহূর্তেই এই সমস্যার সমাধান বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। স্পেসজাংক সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আমাদের সামনে দুটি রাস্তা খোলা আছে।এক, পরবর্তী এক হাজার বছর কোনো রূপ মহাকাশ অভিযান থেকে নিজেদের বিরত রাখা। যাতে স্বাভাবিক নিয়মেই মহাকাশে আবর্জনার সংখ্যা কমে যায়। দ্বিতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিকবোধকে কাজে লাগিয়ে মহাকাশের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গিয়ে ধ্বংস করে দিতে হবে। কিন্তু এটা অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ। এছাড়া আধুনিক উন্নত ক্ষমতা যুক্ত লেসার রশ্মির সাহায্যে এদেরকে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
খ) একধরনের রোবট-নিয়ন্ত্রিত মহাকাশযান পাঠানো যেতেপারে, যারা অকেজো কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে শনাক্ত করবে, তাদের কার্যকরী অবশিষ্ট যন্ত্রাংশকে উদ্ধার করেপৃথিবীতে নিয়ে আসবে। ফলে স্পেসজাংকের পরিমাণ কমবে, এই যন্ত্রাংশগুলিকে ভবিষ্যৎ অভিযানে ব্যবহার করা যাবে ও অর্থনৈতিক ব্যয়ভার কমবে।
গ) রোবোটিক মহাকাশযান যা স্পেসজাংকগুলিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এনে নিপুণভাবে ধ্বংস করে দেবে।
ঘ) স্পেসজাংক কমতে পারে যদি আমরা একই মহাকাশযান বা রকেটকে বারবার ব্যবহার করতে পারি। এই পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেটের গবেষণা ও নির্মাণের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে।এতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নিয়েছে Space X সংস্থা।
কিন্তু সবশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে যে মানুষের সদিচ্ছা ছাড়া কোনও সফলতা লাভ সম্ভব নয়। আমাদের তাই (প্রধানত মহাকাশঅভিযানের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনকে) সচেতন করতে হবে যে মহাকাশও আমাদের পরিবেশ। একে দূষিত করার অর্থ, আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রভাবিত ও সংকটময় হয়ে ওঠা। তাই মহাকাশের আবর্জনা সাফাই করতে হবে এবং ক্ষুদ্রব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থে অহেতুক মহাকাশ অভিযানের সংখ্যা যথাসম্ভব কমাতে হবে। আমরা বর্তমান যুগে টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং, জি.পি.এস, ইন্টারনেটের মতো সুবিধা উপভোগ করছি। তাই মহাকাশে আবর্জনা বৃদ্ধি পেলে আমরা দৈনন্দিনের এইসব সুবিধা থেকে শীঘ্র বঞ্চিত হব।
Add Comments