‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ’ – কবির এই চরম উপলব্ধি আমাদেরকে অবাক করলেও একই সঙ্গে একটি ছোট্ট প্রশ্ন মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়। বিশ্ব এবং আকাশ ঠিক কী? এর ব্যাপ্তিই বা কতটুকু? আর প্রাণ? সে তো আরও বিস্ময়কর! আধুনিকতম বিজ্ঞান এখনও পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের নিঃসন্দেহ খোঁজ দিতে পারে নি। তবে কি এই ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবী একা একটি প্রাণের সঞ্চয় ভাণ্ডার! সৌরজগতে তো অন্ততঃ তাই। এই গুলো সবই লাখ টাকার প্রশ্ন। উত্তর খুব কমই পাওয়া গেছে। আমাদের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা পৃথিবী গ্রহটি সূর্য নামে যে নক্ষত্রকে অবিরাম পাক খেয়ে চলেছে, সেই সূর্যই বা কী? সে কি অমর অবিনশ্বর? থাকবে কি এভাবেই চিরদিন? সূর্য আসলে একটা প্রচন্ড রকমের গরম গ্যাসীয় দৈত্য। জন্ম মোটামুটি আজ থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের প্রধান ধারার একটি হলদে বামন গোছের তারা হল সূর্য। এর মোট ভরের তিন চতুর্থাংশই হাইড্রোজেন। বাকি অংশ হিলিয়াম এবং ভারি কিছু মৌলিক পদার্থ – যেমন অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, আয়রন ইত্যাদি। এই তারার মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন (৬২০০০০০০ কেজি) হাইড্রোজেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে আর তৈরি করছে বিপুল পরিমাণ শক্তি এবং হিলিয়াম অবশেষ। এই বিপুল পরিমাণ শক্তি সূর্যের কেন্দ্রীয় অংশের উষ্ণতা করেছে প্রায় ২ কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস আর পৃষ্ঠের উষ্ণতা প্রায় ৬০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০৯ গুণ বেশি আর এর ভর পৃথিবীর ভরের চেয়ে ৩৩,৩৩৩ গুণেরও বেশী। এই নক্ষত্র গত ৪০০ কোটি বছর ধ’রে প্রায় একই রকম আছে কিন্তু এমনটাই কী থাকবে চিরকাল! এখনও পর্যন্ত সূর্যের প্রায় ৭১ শতাংশ হাইড্রোজেন আর প্রায় ২৭ শতাংশ হিলিয়াম আছে। অর্থাৎ কমছে হাইড্রোজেন জ্বালানি। হিসেব বলছে এই হারে পুড়তে থাকলে সূর্যের জীবনকাল খুব বেশী হলে আরও ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি বছর। তাহলে তো সূর্যেরও শেষ আছে, সেও ফুরিয়ে যাবে একদিন। কয়েকশো কোটি বছর পর সূর্য জ্বালানি অনেকটাই পুড়িয়ে ফেলবে এবং একটা লাল দৈত্যাকার নক্ষত্রে পরিণত হবে। তখন এর আয়তনও যাবে অনেকটা বেড়ে, বাড়তে বাড়তে পৃথিবীকে প্রায় ছুঁয়েই ফেলবে। যদিও এই ঘটনার অনেক আগেই পৃথিবীর উষ্ণতা চরমভাবে বেড়ে যাওয়ার জন্য পৃথিবী প্রাণ শূন্য হয়ে যাবে। তাহলে? তখন কি চিরতরে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর প্রাণ? নাকি অন্য কোনো ঠিকানায় ঘাঁটি গাড়বো আমরা! যদি তাই হয়, তাহলে কোথায়? সৌরজগতের কোনও গ্রহে নতুন ঠিকানা হবার সম্ভাবনা না থাকবারই কথা। সূর্যই যেখানে মরে যাবে সেখানে সৌরপরিবারের অন্য সদস্যদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা না থাকারই কথা। অতঃকিম? তাহলে একটু ঘরের বাইরে, না-হলে দেশের বাইরে ভাবতে হবে।
আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একটা নক্ষত্র। এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথে সর্বাধিক প্রায় ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র থাকতে পারে। আকাশগঙ্গা ছায়াপথ একটি নিষ্ক্রিয় সর্পিল আকৃতির ছায়াপথ। এই ছায়াপথ আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩ লক্ষ কোটি (৩০০০০০ কোটি) গুণ বেশী ভারী। অর্থাৎ এই বিপুল পরিমাণ ভরের সবটা নক্ষত্র সদস্যদের ভর নয়। তাহলে? আসলে নক্ষত্র ছাড়াও রয়েছে মহাজাগতিক গ্যাস, ধুলো আর অন্যান্য বস্তু এবং অবশ্যই একটা কৃষ্ণ গহ্বর। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। এদের সঙ্গেই এই ছায়াপথে রয়েছে কয়েকশো কোটি গ্রহ। আমাদের এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথটা আড়াআড়ি প্রায় ১ লক্ষ আলোকবর্ষ (১ আলোকবর্ষ মানে ৯.৫ লক্ষ কোটি কিলোমিটার) আর একে লম্বায় ধরলে (বেধ) হবে প্রায় ২০ হাজার আলোকবর্ষ। আমাদের সূর্য ওই আড়াআড়ি দূরত্বের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে থেকে প্রতি সেকেন্ডে ২২০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ওই কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ ক’রে চলেছে। এভাবে একবার ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে প্রায় ২৫ কোটি বছর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এখনও পর্যন্ত পাওয়া গেছে প্রায় ২০০০০ কোটি ছায়াপথ। এই ছায়াপথগুলোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে দূরের ছায়াপথ আমাদের সূর্যের থেকে প্রায় ৩২০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে আছে। অর্থাৎ এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অত্যন্ত ক্ষুদ্র এক সদস্য হল আমাদের সৌরজগৎ। তার অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসার আগে কি খুঁজে পাব আমরা নতুন কোনো ঠিকানা?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের হিসেব বলছে, সৌরজগতের বাইরে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মধ্যে আরো অন্তত ১৬০০০ কোটি গ্রহ আছে যারা নক্ষত্রদের চারদিকে ঘুরছে। যদি মিল্কিওয়ে ছায়াপথে ২০০০০ কোটি নক্ষত্র আছে ধরা হয়, তবে ১১০০ কোটি পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে যারা তাদের পালিকা নক্ষত্রের থেকে এমন দূরত্বে আছে যেখানে আবহাওয়া আমাদের পৃথিবীর মতো হওয়া সম্ভব। এদের উষ্ণতা, আবহাওয়ার প্রকৃতির সঙ্গে পৃথিবীর আবহাওয়ার মিল থাকতে পারে। আবার লাল বামন জাতীয় নক্ষত্রের চারদিকে ঘুরছে এমন গ্রহের কথা ধরলে এই সংখ্যা ৪০০০ কোটিতে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এই গণনা ক’রে পাওয়া হিসাবের সব গ্রহগুলোকে এখনও নিশ্চিত ক’রে চেনা যায়নি। ২০১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৮২৩টি এমন বহির্গ্রহ নিশ্চিত ক’রে চেনা গেছে। এই গ্রহ গুলো ২৮৬০টি নক্ষত্রের চারদিকে ঘুরছে। আবার ৬৩২টি নক্ষত্রের একটার বেশী গ্রহ আছে। যেমন ‘কেপলার- ৯০’ এবং ‘এইচ.ডি ১০১৮০’ নক্ষত্রের গ্রহ পরিবারে অন্তত ৭টি ক’রে গ্রহ আছে।
কেপলার ৯০-তে ২০১৭ সালে অষ্টম গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম ৬টা গ্রহ আকারে পৃথিবীর মতো থেকে নেপচুনের কাছাকাছি। আবার এরা সবাই এদের পালিকা নক্ষত্রের থেকে সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যেকার দূরত্বের সমান দূরত্বে (১ আ্যস্ট্রনমিক্যল ইউনিট) আছে। তবে এদের প্রথম পাঁচটা গ্রহ আবার চাঁদের মতো নক্ষত্রের দিকে একটাই দিক ক’রে আছে। অর্থাৎ এদের একটা দিকে সবসময় রাত, অন্যদিকে সবসময় দিন। এই নক্ষত্র পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫৪৫ আলোকবর্ষ দূরে তক্ষক নক্ষত্রমণ্ডলে ( constellation Draco) আছে।
প্রথম যে নক্ষত্রের চারদিকে ৬টা গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে সেটা হল ‘কেপলার-১১’। পৃথিবী থেকে প্রায় ২০০০ আলোকবর্ষ দূরে সিগনাস নক্ষত্রপুঞ্জে এই নক্ষত্রটাকে পাওয়া গেছে। এর সব গ্রহগুলোই পৃথিবীর চেয়ে আকারে বড়। আবার অনেকটা সূর্যের মতো তারা ‘এইচ.ডি ১০১৮০’-তে অন্তত ৭টি এবং সম্ভবত ৯টি গ্রহ আছে। এই নক্ষত্র পৃথিবী থেকে প্রায় ১২৭ আলোকবর্ষ দূরে হ্রদ মন্ডলে (constellation Hydra) রয়েছে। ৫৫ ক্যানক্রি, পৃথিবী থেকে ৪১ আলোকবর্ষ দূরে কর্কট রাশির একটা নক্ষত্র। এটা আবার একটু অন্যরকম। এখানে আবার একটা হলদে বামন আর একটা লাল বামন নক্ষত্র একসঙ্গে একটা নক্ষত্র-যুগল তৈরি করেছে। এই যুগলে হলদে বামনের চারধারে ৫টা গ্রহ পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে চারটের ভর বৃহস্পতির ভরের সমান, অন্যটা নেপচুনের সমান। এই রকম ‘৫১ পেগাসি’, ‘আপসিলন আ্যনড্রোমিডা’, ‘গ্লিসে ৮৭৬’ নক্ষত্রমন্ডলে একের বেশী গ্রহের খোঁজ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের একাধিক গ্রহের নক্ষত্র পরিবার হল গ্লিসে, পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ আলোকবর্ষ দূরে আছে।
২০০৯ সালের মে মাসের পর থেকে কেপলার টেলিস্কোপ পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে থেকে কয়েক হাজার বহির্গ্রহ নিশ্চিত ক’রে আবিষ্কার করতে পেরেছে। কেপলার-এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি পাঁচটা সূর্যের মতো নক্ষত্রের একটাতে অন্তত পৃথিবীর মতো একটা গ্রহ উপযুক্ত পরিবেশ থাকার মতো অবস্থানে আছে। আবার আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথে এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে দূরের গ্রহ SWEEPS-04 এবং SWEEP-11 যারা পৃথিবী থেকে প্রায় ২৭০০০ আলোকবর্ষ দূরে আছে। এই দূরত্ব মিল্কিওয়ে ছায়াপথের আড়াআড়ি দূরত্বের চারভাগের একভাগ। আবার পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছের বহির্গ্রহ হল প্রক্সিমা সেনটাউরি-বি। এই গ্রহটা পৃথিবী থেকে ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে আলফা সেনটাউরি নক্ষত্র মন্ডলের প্রক্সিমা সেনটাউরি নক্ষত্রের চারদিকে ঘুরছে। গ্রহ মাত্রেই যে কোনো নক্ষত্রের চারদিকে ঘুরবে তা কিন্তু নয়। এমনও গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা কোনো নক্ষত্রের চারদিকে ঘুরছে না, স্বাধীনভাবে ছায়াপথের কেন্দ্রকে পাক খাচ্ছে। এরা মহাশূন্যে মুক্তভাবে আছে। বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের ছায়াপথে এই ধরনের মুক্ত গ্রহের(rough planet) সংখ্যা কয়েক লক্ষ কোটি হতে পারে। শুধু যে আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথেই রয়েছে গ্রহ তা কিন্তু নয়, গ্রহ থাকতে পারে অন্য ছায়াপথেও। যেমন আমাদের পড়শী ছায়াপথ আ্যনড্রোমিডা-তে বৃহস্পতি গ্রহের চেয়ে প্রায় ৬ গুণ বড়ো গ্রহ ‘PA-99-N2’-র কথা জানা গেছে। আরো গ্রহ থাকার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই সব বহির্গ্রহগুলোর মধ্যে কোনো কোনটাতে প্রাণসৃষ্টির মতো উপযুক্ত পরিবেশ থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির জন্য সূর্যের থেকে সুবিধাজনক দূরত্ব, পৃথিবীপৃষ্ঠে থাকা জল একটা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। কোনো বহির্গ্রহেও যে তেমনটা নেই তা বলা যাবে না। বরং ১৯৬১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ ডঃ ফ্যাঙ্ক ড্রাক এবং জ্যোতির্বিদ সান্তাক্রুজ ড্রাক গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে দেখালেন যে, আমাদের এই ছায়াপথেই অন্তত ১০ হাজার গ্রহে বুদ্ধিমান জীব থাকতে পারে। তবে এটা একটা বিতর্কিত মতবাদ। বাস্তব ক্ষেত্রে এখনও তেমন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ‘প্যানসপারমিয়া তত্ত্ব’-কে মেনে নিলে মহাবিশ্বময় জীবের সুপ্ত বীজ উল্কা, ধূমকেতু বা মহাজাগতিক বস্তুর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, বেড়ে ওঠার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি পেলেই নিজেদের জগৎ তৈরী ক’রে ফেলবে। ২০০৪ সালে Ward এবং Brownlee আর অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীদের মতে habitable zone বা বাসযোগ্য অবস্থানে থাকলেই বা গ্রহের পৃষ্ঠে জল থাকলেই যে কোনো অপর নাক্ষত্রিক গ্রহে জীব থাকার সম্ভাবনা থাকবে সেটা নাও হতে পারে। হতে পারে অন্য কোনো গ্রহে অন্য কোনো পরিবেশে অন্য বৈশিষ্ট্যের জীব সৃষ্টি হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে! এর সঙ্গে জড়িত আরো অনেক শর্ত। যেমন গ্রহটার ভৌগোলিক চরিত্র, জৈব-রাসায়নিক চরিত্র ইত্যাদি। তবে পৃথিবীর অনিবার্য ধ্বংসের কথা মাথায় রেখে মানুষকে যদি অন্য কোনো ঠিকানা খুঁজে বের করতেই হয়, তবে বাসযোগ্য অবস্থানে থাকা কোনো গ্রহের কথাই ভাবতে হবে। না-হলে লক্ষ লক্ষ বছরের চেষ্টায় বিবর্তিত হওয়া এই পার্থিব জীবগোষ্ঠীর পক্ষে হঠাৎ ক’রে অন্য একটা নাক্ষত্রিক পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে।
Add Comments