নাঃ! কোন ছবি তুলতে ইচ্ছে করেনি।
আমস্কালপ্লাটজ্ স্মৃতিসৌধ, ওয়ারশ পোলান্ড। সকাল ৬টা। ধূসর সকালের অস্পষ্ট দিগন্তরেখায় অসংখ্য মানুষের সিল্যুয়েট। স্টভকি্ আর জিকা স্ট্রিটে তখন অনেক গাড়ির ভীড়। নিঃশব্দে! তিন দিকে বড় বড় হোটেল, মাঝখানে প্রায় মূখ গুমড়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধের সাদা-কালো মার্বেলের দেওয়ালে পাক খেতে খেতে হারিয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দে যেন অনেক অভিমান। বেহালা-চেলো-বাঁশির কোমল পর্দায় ‘সেই সুর’, যা একদিন চিরবদায় জানাতে প্রস্তুত থাকত প্রতিমূহুর্তে। ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯। সারা পৃথিবীর কোথাও কোথাও, ঠিক এভাবেই নিঃশব্দে জড়ো হয়েছিল কয়েক লক্ষ্য মানুষ। বিশ্বের নাগরিকত্বে যাদের অন্যতম পরিচয় এরা ‘ইহুদি’। তথ্য সংবেদনশীল প্রচার মাধ্যমের উপেক্ষা সহ্য করেই এরা এলেন, স্পর্শ করলেন, সূর্য অঠার আগেই স্পর্ধিত গলায় বলে উঠলেন, ‘আমরা ছিলাম-আছি-থাকবো, মাথা উঁচু করেই। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, সভ্যতাকে সঠিক পথে হাটঁতে হলে।‘
অসউইজ্-এর বন্দীদের জীবন্ত পোড়ানোর চুল্লি ।
আশি-নব্বই বছরের বেশি কিছু মানুষ ততক্ষণে স্মৃতিসৌধের পিছনে হাতড়ে হাতড়ে খুজেঁ পাওয়ার চেষ্টা করছেন সেই বিশাল মাঠটির কোন একটা অংশকে, যেখানে প্রতিদিন হাজার মানুষকে দাঁড় করিয়ে ‘বাছাই’ করা হত’ কোন মারণচুল্লিতে পাঠানো হবে এই ‘অবাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীকে’। হয়তো চোখ বুজলেই তারা শুনতে পান লাউডস্পীকারে ভেসে আসা তীব্র ঘোষণা ‘স্টেনগ্স্টেনশ্ বেস্ত্রাফে’ (কঠিন শাস্তি পেতে হবেই)!
ইতিহাসের বয়স এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯, ভোর রাত তিনটে। পোলান্ডের শহরগুলি কেঁপে উঠেছিলো বিধ্বংসী বোমার আঘাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ন্যাশানাল সোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি ওরফে ‘নাজি’ পার্টির বিশ্ব দখলের রক্তাক্ত ইতিহাস-মারণযজ্ঞের তান্ডবলীলা। ইতিহাসবিদরা একে চিহ্নিত করেছেন ‘হলোকাস্ট’ নামে। যার সঠিক বাংলা পরিভাষা নেই। শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘হলোকাস্টন্’ থেকে, যার অর্থ হল ‘আগুনে পুড়িয়ে মারা’। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস এই শব্দটিকে একেবারেই নির্দিষ্ট করেছে ‘ নাজিদের পরিকল্পিত ইহুদি নিধন যজ্ঞকে’ ধিকৃত করার জন্য। হলোকাস্টের ৭০ বছর। বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল একটা নড়েচড়ে বসার তোড়জোড়। কিন্তু যে জার্মানিতে এই ইতিহাস সবচেয়ে বেশি ‘নিষিদ্ধ’, ‘অনালোচিত’, যে ইতিহাসের ঠিকানা খোঁজ করলে জার্মানির রাস্তায় ঠান্ডা চোখের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি এখনও যেখানে একনিমেষে ৭০ বছর আগেকার সেই হিমশীতল অনুভূতিকে শিরদাঁড়ায় প্রবাহিত করে তোলে, সেখানে ইতিহাসের সন্ধানে হাজির হওয়া কি আদৌ সহজসাধ্য?
বির্কানাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের রেললাইন। এই পথেই নিয়ে আসা হতো বন্দীদের।
না, বিশ্বের কোন দেশের কোন ভ্রমণসংস্থা এই ইতিহাস স্পর্শ করার জন্য কোনরকম ‘সুবিধাজনক প্যাকেজ’ ঘোষণা করেনি। অগত্যা একেবারেই নিজস্ব উদ্যোগে এবং হঠাৎই হয়ে যাওয়া কিছু দেশের আমন্ত্রণকে পুঁজি করে কলকাতা থেকে পাড়ি দিয়েছিলাম ‘হলকোস্টের’ নির্মম ইতিহাসে, অন্ততঃ একটা স্মরণসময়ে নিজেদেরকে যুক্ত করার প্রবল ইচ্ছে থেকে। র্যুট ম্যাপ, বার্লিন-ন্যূরেমবুর্গ-ওয়ারশ-ক্রাকাও-অস্উইজ্-প্রাগ। ঠিক যেদিনটাতে ওয়ারশ যুদ্ধ জিতে নাজিবাহিনী প্রথম পোলান্ড দখল করলো, ৭০ বছর পরে ঠিক সেদিন আমরা পৌঁছালাম বার্লিনে।
যে শহরকে হিটলারের শহর, গেস্টাপো এস এসদের হেডকোয়ার্টার বলে পৃথিবী একসময় চিনতো, আজ সেখানে একটি সভাও হয়নি সেই নির্মম ইতিহাসকে ধিক্কার জানিয়ে, একটি ফুলও কেউ অর্পণ করেনি ১কোটি ১০ লক্ষ খুন হয়ে যাওয়া নিরপরাধ শিশু-নারী- পুরুষের উদ্দেশ্যে। কোন স্কুলে একমিনিট নিরাবতা পালনের ‘ঔদার্য’ জানানোর স্পর্ধা কেউ দেখায়নি। কারণ ‘এ ইতিহাস আমাদের পক্ষে সুখকর নয়, আমরা একে ভুলতে চাই’ রাইখস্ট্যাগের’ প্রবেশ পথে লটকানো এক লাইনের সরকারি ঘোষণার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়, যখন প্রবেশ করা যায় রাইখস্ট্যাগের ভিতরে। যে রাইখস্ট্যাগের মাথায় নাজি পার্টির পতাকা নামিয়ে রেড আর্মি পতাকা উড়িয়ে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে স্বস্তির, বেঁচে থাকার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে তুলেছিল, সেই রাইখস্ট্যাগে কোন দর্শনার্থীর অধিকার নেই ঘরগুলিকে দেখার। দেখতে গেলে ‘আবেদন’ করতে হবে, আবেদন যুক্তিগ্রাহ্য হলে ‘ইন্টারভিউ’ হবে, যদি তা ‘মনপসন্দ’হয়, তবেই মিলবে প্রবেশাধিকার, নাহলে লিফটে চড়ে সোজা ছাদের একটি রেস্তোঁরায় কফি খেয়ে ফেরত আসতে হবে। সমস্যাটি এতই গুরুতর ৭০ বছর বাদেও? হাজারে হাজারে ট্যুরিস্ট আসছেন, কিন্তু প্রবেশাধিকার নেই কারুর। সেখানে আমেরিকা-জাপান-কী ভারত, সবাই এক। কপালে ভাঁজ পড়ল রাইখস্ট্যাগ থেকে বেরিয়ে পাথরের রাস্তায় নামার পর। রাস্তায় বাঁধানো একটি বিশাল স্মৃতিফলক। ৯ মে, ১৯৪৫ রাইখস্ট্যাগ শেষ যে ৩৫ জন নাজি সৈন্য মিত্রবাহিনির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিল, তাদের স্মরণে নাম ও বয়স উল্লেখ করে তৈরি হয়েছে স্মৃতিফলক। হ্যাঁ! তাতে টাটকা ফুলও দেওয়া হয় প্রতিদিন। স্মরণ-ফিরে দেখা-ইতিহাসকে ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়ার সুস্থবোধে তাড়িত কয়েক হাজার বিশ্বের নানা দেশের মানুষ হাতে ম্যাপ নিয়ে রীতিমত গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন বার্লিনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কি দেখবেন, কোথায় দেখবেন – এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য একজনও ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ পুলিশ বা ট্যুরিস্ট গাইড কোথাও নেই। ‘চিড়িয়াখানা-মিউজিয়াম থেকে নাইট ক্লাব, বেড়ানোটা এখানেই শেষ করলে ভালো হয় না কি?’ – তাঁদের কাছে বার্লিন ওয়াল, চেক পয়েন্ট চার্লি, হিটলারের বাঙ্কার রীতিমতো ‘ছুকু খানসামা লেন’ কি ‘গড়পারের’ রাস্তা চেনানোর থেকেও যেন কঠিনতম ধাঁধা!
আলবার্ট-স্ট্রাসে ৮। গেস্টাপো সদর দপ্তরের কিছু অংশ।
কিন্তু মানুষকে রোখা বড় কঠিন। বার্লিন ওয়ালের মাত্র ৩০০ মিটারের একটা অংশ, আর চারপাশে তড়িঘড়ি গজিয়ে ওঠা চোখধাঁধানো অট্টালিকার সামনে ফুটপাতে লাগানো কিছু ইতিহাস, কিছু ছবি কিন্তু তাই দেখার জন্য যেন ‘দুর্গাপূজোর’ ভিড়। ফুটপাতে ছোট টুলে সাজিয়ে রাখা রাশিয়ান-পূর্ব জার্মানির টুপি, মনোগ্রাম, লাইটার, পতাকা, ষ্ট্যাম্প। দুর্লভ শ্যাম্পেনের থেকেও চড়া দামে কিনে নিচ্ছেন সকলেই।
পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানির মূল সীমানা ছিল চেক পয়েন্ট চার্লি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মিত্রবাহিনির সঙ্গে জার্মানির চুক্তি অনুযায়ী এই এলাকাটির অধিকার জার্মানি ছাড়াও আমেরিকার ছিল। সেই চেক পয়েন্ট আর আমেরিকার সেই প্রশাসনিক ভবনটি শুধুমাত্র টিকে আছে। ভবনটির সামনে এখনো ঝুলছে চার দেশের পতাকা- সোভিয়েত, ব্রিটেন, পূর্ব জার্মানি ও আমেরিকার। বাড়িটিকে আমেরিকা মিউজিয়ামে রুপান্তরিত করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এখানেই একমাত্র পূর্বতন পূর্ব জার্মানির ইতিহাস কিছু আছে। আশ্চর্য লাগবে দুদিকে গা ঘেঁষে একই উচ্চতায় একদিকে শপিং মল অন্যদিকে একটি হোটেল যেন ঐ বাড়িটিকে ঢেকে ফেলেছে।
বিস্ময় এখানেই শেষ নয়। সমাজতন্ত্র পতনের পর পূর্ব বার্লিনের যাবতীয় বাড়ি, মিউজিয়াম, বিভিন্ন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্ত্বপূর্ন ঠিকানা বুল্ডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে একটার পর একটা পেল্লায় ইমারত, স্টেশন, শপিং মল, পার্কিং প্লাজা। একটি ইতিহাসকেও রাখা গেল না?
চেক পয়েন্ট চার্লি থেকে এক কিলোমিটার দুরত্বে ছিল গেস্টাপো, এস এস এবং রাইখ সিকিউরিটির সদর দপ্তর। এই সেই সদরদপ্তর যেখানে সরকারি ভাবে ৫ হাজার কমিউনিস্ট, ৩ হাজার সোশালিস্ট, ১০ হাজার বুদ্ধিজীবি-যারা সেসময় ‘রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক’ ছিলেন তাদেরকে খুন করা হয়। ঠিকানা ‘প্রিঞ্চ-আলবার্ট-স্ট্রাসে ৮’। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত গোঁটা বিশ্বের মানুষের কাছে অন্যতম আতঙ্কের ঠিকানা। এই সেই বাড়ি যেখানে প্রতিমূহুর্তে পোলান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটে চলা নির্মম হত্যালীলার রিপোর্ট আসতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাড়িটি প্রায় ভেঙ্গে পড়ে। এটি ছিল পশ্চিম জার্মানির প্রায় সীমানাতে। ১৯৫৬ সালে বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বার্লিনের প্রাচীরের ঠিক পিছনেই ঝোপঝাড়ে চাপা পড়ে ছিল বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭০ সালে আবার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে মাটির তলা থেকে দোতলা বাঙ্কারসহ বিপুল ছবি, মূল্যবান কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। ১৯৮৭ সালে এখানেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যাবতীয় ছবি-কাগজপত্র নিয়ে একটি স্থায়ী প্রদর্শনী তৈরি করে। জার্মানির সরকার এতটুকুও সহযোগিতা করেনি। শুনলে আশ্চর্য লাগবে যে একবারে খোলা মাঠে ল্যামিনেট করে প্রদর্শিত হত একবারে দুষ্প্রাপ্য ছবি, গেস্টাপোদের সেই বিখ্যাত খাতা যেখানে লেখা থাকতো কোন ব্যক্তির গন্তব্য কোথায় – কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্প, না গুলিতে মৃত্যুবরণ। এমনকি আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘সন্দেহজনক’ গতিবিধি নিয়ে গেস্টাপোদের রিপোর্ট পর্যন্ত। মাত্র তিন বছর আগে সেখানে গিয়ে এই দুর্লভ ছবিও তুলে নিয়ে আসার সুযোগ ঘটেছিল।
গেস্টাপো, এস এস এবং রাইখ সিকিউরিটির সদর দপ্তর, ১৯৪১। এখন সেখানেই তৈরি হয়েছে টপোগ্রাফি অফ টেরর ডকুমেন্টেশন সেন্টার
কিন্তু এবারে পৌঁছে রীতিমতো হতভম্ব। গোটা ইতিহাসটিই একেবারে উৎপাটিত। সাইনবোর্ডে লেখা, এখানে তৈরি হচ্ছে ‘টপোগ্রাফি অফ টেরর ডকুমেন্টেশন সেন্টার’। হোক না ‘হলোকাস্টের ৭০ বছর’ – আসুক না কয়ের লক্ষ ‘হুজুগে’ ট্যুরিস্ট, আপাততঃ ইতিহাসের ‘ফ্রি প্রফর্শনী’ বন্ধ! নেই, মানে নেই। আর কেউ তা ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন কিনা জানা নেই।
নাজি কর্মকান্ডের সঠিক ইতিহাসের ঠিকানা খোঁজ করতে গেলে এপ্রজন্মের মানুষকে অন্ততঃ ১৯৯০ সালের আগে প্রকাশিত বই জোগাড় করে পড়ে জানতে হবে। সেটা বেমালুম মালুম হলো ন্যূরেমবুর্গে পৌঁছে। ‘ন্যূরেমবুর্গ হলো সেই শহর যেখানে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত গুপ্তভাবে নাজি পার্টির সমাবেশ হতো, যেখানে ১৯৩০ থেকে নাজি পার্টির ঘোষিত কুচকাওয়াজ শুরু হয়, যেখান থেকেই ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫ সালে কুখ্যাত ‘ন্যূরেমবুর্গ আইন’ ঘোষণা করে হিটলার, যার মাধ্যমে ইহুদিদের প্রকাশ্যে জীবনযাপন সম্পূর্ন নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আবার যেখানে ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৬ ‘ন্যূরেমবুর্গ ট্রায়ালে’ যুদ্ধবন্দী নাজিদের প্রাণদন্ড দেওয়া হয়। এখানে পৌঁছে জানা গেল কুখ্যাত সেই নাজি পার্টির র্যালি গ্রাউন্ডের অর্ধসমাপ্ত কংগ্রেস হলের সিঁড়িতে নাকি ‘ফ্যাসিনেশন অ্যান্ড টেরর’ নামক ঐতিহাসিক প্রদর্শনী রয়েছে, যার নাম ডকুমেন্টেশন সেন্টার। শহর থেকে বেশ দূরে। ‘হলোকাস্টের’ ম্যাপে এই জায়গাটি নেই। সুতরাং ট্যুরিস্টও হাতে গোনা। কেউ জানলে তো যাবে! কিন্তু অপুর্ব প্রদর্শনী। একেবারে নাজি পার্টির জন্মলগ্ন থেকে ন্যূরেমবুর্গের ট্রায়াল পর্যন্ত। ২০০১ সালে তৈরি একেবারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সাজানো প্রদর্শনীতে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নাজি পার্টির উত্থান ও পতনের সচিত্র ইতিহাস সাজানো। খোদ নাজি পার্টির যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রায় একমাত্র জীবিত সাক্ষী ‘পার্টি র্যালি গ্রাউন্ডে’-র ঘরগুলিতে রাখা অডিও ভিস্যুয়াল ধারা বিবরনী। অদ্ভুত লাগবে সেইসময়কার টাকা, পরিচয়পত্র, মেডেল, স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা কাপ-প্লেট, সবকিছুই মেঝেতে কাঁচের ব্লকে সাজিয়ে রাখা, যাতে দর্শনার্থীরা যেতে যেতে পা দিয়ে ‘পাড়িয়ে’ যেতে পারেন! ১৩০০ বর্গমিটার প্রদর্শনীটি দেখে র্রীতিমতো গোলমাল লেগে যাবে, কারণ সব আছে, নেই ইহুদি নিধন যজ্ঞ নিয়ে একটি শব্দ-একটি তথ্যও! হ্যাঁ, অবশ্যই নেই নাজি পার্টির হেরে যাওয়া। মনে হবে যেন হিটলার বিপুল মানুষকে নিয়ে হঠাৎ যুদ্ধ শুরু করেছিল, আবার যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেল – হঠাৎই! নেই মিত্রবাহিনী বা তাঁদের মরণপণ প্রতিরোধ বা প্রতি-আক্রমন নিয়ে একটিও শব্দ। ইতিহাসকে যে এভাবে খন্ড-বিখন্ড করা যায়, তা এর আগে কোন দেশে দেখেনি। আরও অদ্ভূত ব্যাপার এই বাড়িটিতে স্বয়ং হিটলার ৭ বছর থেকেছে। তাঁর পেল্লায় ড্রইংরুম, খাট-পিয়ানো-পড়ার টেবিল সবই অবিকৃত রয়েছে এখানে। কিন্তু প্রবেশাধিকার নেই। যারা হিটলারের বাঙ্কার খোঁজার জন্য বার্লিনের এগলি-ওগলি ঘু্রে বেড়ান, তাঁরা যদি এখবরটা জানতেন!
জার্মানি থেকে সোজা পোল্যান্ডের ওয়ারশ ‘ঘেটো’-তে। ‘ঘেটো’ হচ্ছে ইহুদিদের জন্য তৈরি কারাগার। সারি সারি পাঁচতলা উঁচু বারাকের মতো বাড়ি। চারপাশে পাঁচিল। ওয়ারশ ঘেটো ছিল নাজি বাহিনীর তৈরি বৃহত্তম কারাগার। ১৯৩৯ সালে শুধুমাত্র ওয়ারশ-তে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৪৫ হাজারের বেশি। যুদ্ধের পরে মাত্র তিন হাজারকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়। গোটা শহরটা যেন ইতিহাসের বৃত্তে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত জার্মানির যাবতীয় হত্যালীলা-আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু, ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক পোলান্ড, অশ্রদ্ধার আসনে দুই ব্যবস্থাই। ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে অধ্যাপক, প্রতি মুহূর্তের কথায় তীব্র ঝাঁজ, ইউরোপের কোন দেশে সাধারণ মানুষকে এত বেশি রাজনৈতিক কথা বলতে দেখিনি। গোটা ওয়ারশর মূল জায়গাগুলির সবকটিকেই জার্মানরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই ছবি দেখে অবিকল একরকম দেখতে বাড়িগুলিকে নির্মান করে রাশিয়ান প্রযুক্তিবিদরা। ফলে নতুন-পুরনোর তফাৎ খোঁজা বেশ মুশকিল। কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই বাড়িগুলির খোঁজ পেলাম না, যেখানে গুপ্ত কুঠুরিতে আড়াই বছর একটি শব্দও উচ্চারণ না করে বেঁচে ছিল ৫৮ জন ইহুদি শিশু, যাদের বয়স ছিল সেসময় পাঁচ থেকে এগারো বছর। পরে মিত্রবাহিনী তাঁদের মুক্ত করে। এখনো সকলে বেঁচে রয়েছেন, তবে পোলান্ডে নয়, তাঁরা এখন ইজরায়েলের বাসিন্দা। অদ্ভুত লাগবে ওয়ারশ-র প্রান্তসীমা ধরে সারি সারি ইহুদিদের সেই পুরনো বাড়ি, একজন ইহুদিও নেই, বাড়িগুলিতে অন্য লোকেরা থাকেন, আর সেই পুরনো বাড়ি দেখতে হাজারে হাজারে মানুষ ইজরায়েল-লেবানন-টার্কি-কানাডা-আমেরিকা থেকে ছুটে আসেন। বাড়ির দরজায় কিছু ফুল আটকে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নেন তাঁরা।
পোল্যান্ডের ওয়ারশ-তে এখনও যে ‘ঘেটো’ বা, ইহুদিদের জন্য তৈরি কারাগার, টিকে রয়েছে।
নিজেদের প্রিয়জনের স্মৃতি কত জীবন্ত, কত বেদনাহত হতে পারে, তার প্রায় বিস্ফোরণ দেখলাম পোলান্ডের ক্রাকাও থেকে ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে হিটলার সবচেয়ে জঘন্যতম কসাইখানা অসউইজ্ – বির্কানাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পৌঁছে। হাজারে হাজারে মানুষের ভীড়। প্যারিসের ল্যুঁভ মিউজিয়ামেও এতো দীর্ঘ লাইন দেখিনি। খোঁজ নিয়ে জানলাম মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ন্যূনতম দশ হাজার মানুষ আসেন এখানে (বাদবাকী সময় বরফে ঢাকা থাকে)। কেন – কীসের খোঁজে? সিনেমায় দেখা, বই পড়া যাবতীয় তথ্য যে কত সীমাবদ্ধ, তার প্রথম পরিচয় ঘটলো এখানে এসে। অসউজ্ ছিল হিটলার-হিমলারের যাবতীয় পরীক্ষার কেন্দ্র। কিভাবে ইহুদি-কমিউনিস্ট-সোশালিস্টদের গোটা পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা যায় তার কুখ্যাততম কেন্দ্র ছিল এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মে ১৯৪০ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৯৪৫ পর্যন্ত এই ক্যাম্পে মোট ১১ লক্ষ মানুষকে খুন করা হয়েছে, (সরকারি হিসাবে) যার মধ্যে বেশিরভাগই ইহুদি। এখানে ৬ঘন্টা দেখার অনুভূতিকে কোন ভাষায় প্রকাশ করা ক্ষমতার বাইরে। শুধুমাত্র কয়েকটি মর্মান্তিক দৃশ্যকে না লিখলে বোধহয় অসম্পূর্ন থেকে যাবে। ১৯৪০ সালে পোলিশ বিপ্লবী, কমিউনিষ্ট, অধ্যাপক যুদ্ধবন্দীদের এখানে আনা হত। এবং গুলি করে মারা হত। ১৯৪১ সাল থেকে ইহুদিদের এখানে আনা শুরু হয়। কিন্তু গুলি করে মারতে ‘ক্লান্তি’ এসে যাওয়ায় এখানেই প্রথম গ্যাস চেম্বারের জন্ম দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র দুটো গ্যাস চেম্বারে বেশি খুন না করতে পারায় ১৯৪১ সালে এর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বির্কানাও সেন্টারে অসংখ্য গ্যাস চেম্বার তৈরি করা হয়, যেখানে প্রতিদিন ৬ হাজার মানুষকে মারা হত। মারতে সময় লাগতো ৪৫ মিনিট। তারপর মৃতদেহগুলির শরীর থেকে অলঙ্কার খুলে নেওয়া হত, দেহগুলিকে বার করে আনতো ইহুদি বন্দীরাই, তারপর সারি দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। মানুষ পোড়া ছাইগুলি জড়ো করে পাশের পুকুরে ফেলে দিয়ে আসতো ইহুদি বন্দীরাই। ১৯৪৩ পর্যন্ত কেউই জানতেন না এই ভয়াবহ জেনোসাইডের তথ্য। ১৯৪৩ সালে অসউইজে্ কর্মরত এক পোলিশ সেনা যে আদতে ছিল পোল্যান্ড রেভেলিউশান আর্মির সদস্য, তিনি লুকিয়ে মৃতদেহ পোড়ানোর ছবি তোলেন এবং সেই ছবি ব্রিটিশ ও আমেরিকান সংবাদপত্রে প্রকাশের পর গোটা বিশ্ব আতঙ্কে শিউড়ে ওঠে। ১৯৪৪ সালে আমেরিকান বিমানবাহিনী আকাশ থেকে এই ক্যাম্পের ছবি তোলে। কিন্তু আজ অবধি সেই পোলিশ সেনার তোলা ৭ খানি ছবিই এই মর্মান্তিক হত্যালীলার একমাত্র প্রমাণ।
অসউইজ্ – বির্কানাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে খুন হয়ে যাওয়া হাজার হাজার শিশুদের জুতো।
এই ক্যাম্পের সবচেয়ে কুখ্যাত সেল, ১১ নম্বর সেল। যেখানে যাবতীয় জৈবরাসায়নিক পরীক্ষা হতো। করতো বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে কলঙ্কিত নায়ক জার্মান চিকিৎসক জোশেফ মেঙ্গেল। এর অন্যতম কাজ ছিল যমজ বাচ্চার জেনেটিক সাযুজ্য খুঁজে বার করা, যাতে ভবিষ্যতে যেকোন আর্য রমনীর সন্তান নীল চোখ এবং সাদা চুলের হতে বাধ্য হয়। বন্দীদের আনার পর যমজ বাচ্চাদের এই সেলে নিয়ে আসা হত। তারপর চলতো গিনিপিগের মতো চিঁড়ে ফেলা। ২৬ হাজার বাচ্চাকে (সরকারি হিসাবে) মেঙ্গেল এইভাবে কেটে খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছে জীবন রহস্যকে। এবং ভবিষ্যত পৃথিবীকে এক জাতের করে গড়ে তলার এই কুৎসিততম প্রয়াসে সিলমোহর লাগিয়েছিল স্বয়ং হিটলার।
শুধুমাত্র জার্মানি বা পোল্যান্ড থেকে নয়, এই ক্যাম্পে নরওয়ে, ফ্রান্স, ইতালি, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া সমস্ত জায়গা থেকে ইহুদিদের গৃহপালিত পশু আনার রেলের ওয়াগানে ভর্তি করে আনা হত। প্রথমেই আলাদা করা হত মহিলা ও শিশুদের। কারণ ‘সিলেকশন’ কোড অনুযায়ী এরা সমাজের পক্ষে ননপ্রোডাক্টিভ। মহিলাদের এখানে বেঁচে থাকার সর্ব্বোচ্চ সীমা ছিল এক বছর। শিশুদের মাত্র দশদিন। শুধুমাত্র অস্উইজে ২লক্ষ ৩২ হাজার শিশুকে খুন করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালে মিত্র বাহিনী এই ক্যাম্প দুটি দখল করার পর, সেই সময়ে ধ্বংস না হওয়া কিছু জিনিসকে এই ক্যাম্পের বিশাল বিশাল ঘরে ক্যানভাসের মতো আটকে রাখা হয়। এখানে গ্যাস চেম্বারে ঢোকানোর আগে বন্দীদের সমস্ত চুল কেটে নেওয়া হত, যা থেকে কার্পেট এবং জ্যাকেট তৈরি করতো জার্মানরা। হাজার হাজার মানুষের চুল, সুন্দর বিনুনী বাঁধা-হয়তো বা শেষ মুহূর্তে বেঁচে থাকার স্বপ্ন-! আঁতকে ওঠার পরের ক্যানভাসে শেষ মুহুর্তে উদ্ধার হওয়া দশ হাজার শিশুদের জুতো। যেন স্কুলে লাইন দিয়ে শিশুরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছবি তোলা নিষেধ, তবু শাটারে হাত পড়তেই পিছন থেকে জনৈক মহিলা লেন্সে হাত চাপা দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ‘ডোন্ট টেক্, প্লিজ বি রেস্পেক্টফুল’। চমকে ফিরে তাকালাম, জানি না কোন দেশের, দু’চোখ বেয়ে শুধু কান্নার স্রোত। চওড়া ধূসর ইঁটের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, পাশাপাশি দুই দেশ জার্মানি আর পোলান্ড। এক দেশ নির্মম অধ্যায়কে মুছে ফেলে নতুনভাবে ইতিহাস তৈরি করছে, অন্যদেশ ভয়াবহতাকে সাক্ষী করে বেঁচে রয়েছে। যে ভয়াবহ ‘প্রচার’ একদিন জার্মানিকে বিশ্বের কদর্যতম হত্যালীলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই প্রচার অন্যভাবে ফেরৎ আসছে আজকের বিশ্বে। নতুন ইতিহাস তৈরির ধাক্কা এখানে এসে আবার আছড়ে পড়বে না তো?
কাঁটাতারের পাকানো কুণ্ডলী পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ছাইকে গর্ভে নিয়ে অস্উইজের পুকুর জন্ম দিয়েছে অসংখ্য টিউলিপ ফুলের। হলুদ ফুলগুলি বাতাসে দুলতে দুলতে ফিসফিসিয়ে বোধ হয় বলতে চাইছে, ‘তোমরা আমাদের ভুলিয়ে দিতে দিও না’। এবার জোরে শাটার টিপলাম, অনেকবার।
Add Comments