আজ ডিজিট্যাল শিক্ষার রমরমা বাজার। বহু ঝকঝকে অতি আধুনিক বিদ্যালয়ে দেখি প্রতি ক্লাশে স্মার্টবোর্ড এবং সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিওতে নানা বিষয়ে ছবির বন্দোবস্ত। কম্পিউটারে নানা বিষয়ে ছবি পাওয়া যায়। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ডিজিট্যাল বিজ্ঞান শিক্ষায় কি শিক্ষকের বা হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না? একটি চিনা প্রবাদ আছে যা বলে, “আমি পড়ি আমি ভুলে যাই, আমি দেখি আমি মনে রাখি, আমি করি তো আমি বুঝি”। দেখাও দুরকমের। ডিজিট্যাল প্রক্ষেপ যখন হয় তখন একটি ঘটনা ঘটছে ক্ষণিকের জন্য। সরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষিকা বা শিক্ষক যখন ক্লাশ ঘরে নিজ হাতে কোন পরীক্ষা করে দেখান শিক্ষিকা বিদ্যার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন, প্রশ্ন করেন ছাত্রকে বা ছাত্র প্রশ্ন করে শিক্ষিকাকে। এটি দুমুখি শিক্ষা। কিন্তু, ডিজিট্যাল শিক্ষা একমুখী। সেখানে আলোচনা বা প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই। ছাত্রী যখন নিজে হাতে পরীক্ষা করে তখন শেখা এক নতুন মাত্রা পায়। সে শুধু দেখে না, সে বোঝে। এটা কখনোই ডিজিট্যাল শিক্ষায় সম্ভব নয়। আমি আকাশের তারাদের দৈনিক বা সারা বছরের গতিপথ, তাদের ঔজ্জল্য বা সূর্যের সারা বছর অয়নচলন ইত্যাদি বিষয়ে শিশুদের বোঝাতে চাই তা কি শুধু তারামন্ডলে বা ডিজিট্যাল ভিডিও দেখে বা বই পড়ে বুঝতে পারা সম্ভব? বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদ বা প্রাণীদের যদি চিনতে চাই তাহলে আমাকে বাইরে যেতে হবে, অরণ্যে যেতে হবে। অরণ্যের নিস্তব্ধাকে অন্তরে গ্রহণ করতে হবে। তখন জীবনানন্দের কবিতার অর্থও বুঝতে পারি। কর্ণাটকের বন্দীপুর অরন্যে আছি। খুব ভোরে উঠে দেখি সূর্যের মৃদু আলো গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে আসছে আর সামনের মাঠে অজস্র হরিণ ঘাস খাচ্ছে। তখন জীবনানন্দের কবিতার লাইন মনে আসে, “কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের্র বেলা।/ কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস-তেমনই সুঘ্রান- হরিনেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে/ আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি”। এ কি ক্লাশে পড়িয়ে বা ডিজিট্যাল ভিডিও দেখিয়ে অনুভবে আনা যায়? ডিজিট্যাল শিক্ষা কখনোই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে দখল করতে পারে না। পরিপূরক হতে পারে। কিন্তু, ভারতের হাজার হাজার নিরন্ন বিদ্যালয়ে ডিজিট্যাল শিক্ষার বন্দোবস্ত করা এক স্বপ্ন কল্পনা। দেখি, ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান হালহকিকত কী?
আমি সারা ভারতবর্ষে বিদ্যালয়ে কিভাবে বিজ্ঞান পড়াতে হবে সে বিষয়ে শিক্ষিকা-শিক্ষকদের কর্মশালা নিয়ে আসছি আজ প্রায় ২৭ বছর ধরে। প্রায় ৩০০-এরও বেশি কর্মশালা নিয়েছি। আমার স্লোগান হল “যেখানে কোন ল্যাবরেটারি নেই সেখানে কি করে ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে পরীক্ষা করে ক্লাশ ঘরে বিজ্ঞান শেখানো যায়”। এই বোধ আমার আসে বিজ্ঞান মিউজিয়ামে কাজ করে এবং পাঁচ বছর দূরদর্শনে ‘কোয়েস্ট’ নামে একটি বিজ্ঞান কুইজে অংশ গ্রহণ করে। ঐ অনুষ্ঠানে আমরা প্রায় সাড়ে তিনশো পরীক্ষা করেছিলাম ফেলে দেওয়া জিনিশপত্র দিয়ে। এই কুইজ দেখতো নাম করা বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষও। ঐ সাধারণ জিনিষ দিয়ে পরীক্ষা তাদের আকৃষ্ট করতো।
সারা ভারতে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা, সে বিদ্যালয় সরকারী হোক বা এলিট হোক, সব বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান শিক্ষা মুখস্ত করে পড়া এবং পরীক্ষার খাতায় তা বমন করা। এর একটা বড় কারণ আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি। পরীক্ষা ছাত্রী-ছাত্রদের মুখস্ত করবার ক্ষমতা যাচাই করে। বোধের বিকাশ হল কিনা তা যাচাই করে না। কোন কিছু না বুঝেই মুখস্ত করে ৮০-৯০ মার্ক পাওয়া যায়।আরেকটি বড় কারণ, যেসব শিক্ষক বিদ্যালয়ে পড়ান তাঁরাও এসেছেন মুখস্ত বিদ্যার মধ্য দিয়ে যাঁদের পরীক্ষা দেখা বা করার কোন অভিজ্ঞতা নেই। ‘চক ও টক’ উপায়ে পড়িয়ে, নোট দিয়ে মুখস্ত করিয়ে দেওয়া অনেক সহজ। একবার এইভাবে পড়ানো অভ্যেস হলে শিক্ষকের মনেও নিউটনের জাড্যতা সূত্র কাজ করে যা শিক্ষককে শিক্ষন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে প্রচন্ড বাঁধা দেয়।একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার নাতনি তখন এক খুব নাম করা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ওকে আমি আর্কিমিডিসের সুত্র, ভাসনের সূত্র সব পরীক্ষা করে বুঝিয়েছি ক্লাশে পড়াবার আগেই। যে বিজ্ঞানের বই ঐ ক্লাশে পড়ানো হয় তার লেখিকা হচ্ছেন দিল্লির এক খুব নাম করা স্কুলের বিজ্ঞানের প্রধান শিক্ষিকা। বইয়ে লেখা আছে কোন বস্তু যত জলের গভীরে যাবে তত প্লবতা বেড়ে যাবে। একটি বস্তু যতখানি তরল সরায় তার ওজন হচ্ছে প্লবতা। ক্লাশে পড়াবার সময় শিক্ষিকা বইয়ে যা লেখা আছে তাই বলেছেন। তখন আমার নাতনি বলেছে তা কী করে হবে মিস? একটি বস্তু যত নিচেই যাক সেতো একই ওজনের জল সরাবে। প্লবতা-তো একই থাকবে।শিক্ষিকা তাকে বলেছেন,‘তুমি থামো, তুমি confused’ । নাতনি বাড়িতে ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলি যে সে ঠিক বলেছ্। বর্তমান যে বিজ্ঞানের বই পশ্চিমবঙ্গে পড়ানো হয় তার আগে যে বই পড়ানো হত তাতে বিশেষ করে দুটি ভুল পরীক্ষা সারা ভারতের বিজ্ঞানের বইতেও, এমনকি এন্ সি আর টি-এর বইতেও ছিল। বহুদিন ধরে এই ভুল চলে আসছিল। এখনো অনেক প্রদেশের বিজ্ঞানের বইয়ে এই ভুল পরীক্ষা আছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিজ্ঞানের বইয়ে নেই। পুরনো বই যখন পড়ানো হত তখন আমি প্রায় ১০-১৫ পাতা নোট পাঠাই পঃ বঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতির কাছে। চারটে সভাপতি পালটে যায় কিন্তু কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ভুল শোধরাবার। যদিও চারজনই আমার সঙ্গে একমত ছিলেন। পাঁচজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছিলেন আমার নোট সম্বন্ধে। কিন্তু, ভুল থেকেই যায়। আমি এন সি আর টি-এর একটি কমিটির সদস্য ছিলাম। সেখানেও আমার তিন বছর লেগেছিল ঐ পরীক্ষা দুটির ভুল শোধরাতে।
যে যুগে আমরা বাস করছি তাকে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অভূতপূর্ব বিকাশ হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। পরমাণু বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এই যুগ সম্বন্ধে জর্জ ট্রেসেল তাঁর “ ইনফরমেশন এজুকেসন “ গ্রন্থে লিখছেন, “We are well into the age of thinking machine, designer genes and a fantastic ability to travel, communicate and annihilate each other”। এই যে ‘annihilate’ সে সম্বন্ধে প্রবন্ধের শেষে আলোচনা করা যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জরিত। আজ বিজ্ঞানে প্রগতি না হলে নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি সম্ভব নয়।একটি দেশকে বিজ্ঞানে অগ্রগতি করতে হলে তার বিজ্ঞানশিক্ষা এবং তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার বনিয়াদও শক্ত হতে হবে।ইদানিং বিভিন্ন বিস্ববিদ্যালয়ে এবং কলেগে নুতন নূতম আধুনিক বিষয়ের কোর্স খোলা হচ্ছে। এটি প্রয়োজন কিন্তু এটি করতে গিয়ে সনাতন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষা নিয়ে বহু কমিশন গঠিত হয়েছে রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে। শিক্ষা নীতি ঘোষিত হয়েছে। ২০০৫ সালে প্রচুর গবেষণা এবং বহু শিক্ষাবিদদের প্রচেস্টায় জাতীয় শিক্ষাক্রম কাঠামো (National curriculam Framework বা NCF) প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং কিভাবে তা রূপায়িত হবে তা বলা হয়েছে। এই সমস্ত কমিশনের যেসমস্ত প্রস্তাব তার বেশির ভাগই কার্যকারী করা হয়নি। যদিও এই সমস্ত কমিশন সরকারই স্থাপন করেছে। স্বাধীনতার আগে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার কোন বিশেষ আয়োজন ছিলনা। বিদ্যালয়ে পড়াশুনো শেষ করে কলেজে ঢোকার পরেই ইন্টারমিডিয়েটে ক্লাশ বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে ভাগ হয়ে যেত।পঞ্চাশের দশকের প্রথম ভাগ থেকে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রথম প্রবেশ।
বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে প্রধানত ছিল শিশুর সঙ্গে তার পরিবেশের পরিচয়-উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ, স্বাস্থ্য এইসব বিষয়ে পাঠ। দৈনিক জীবনে যার সাথে আমাদের পরিচয় সেগুলোই পাঠ্যসূচীতে থাকত। এর জন্যে শিশুদের বহির্জগতের সম্বন্ধে ধারণা হত। বিদ্যালয়ে কোন ল্যাবরেটারি ছিলনা। কিন্তু অনেক বিদ্যালয়ে ক্লাশে ছোটখাটো পরীক্ষা করে দেখান হত।
ইন্টারমিডিয়েটে ঢোকার পরই সত্যিকারের বিজ্ঞান পঠনপাঠন শুরু হত। যে পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচী সেসময় ছিল তাতে ল্যাবরেটারীতে পরীক্ষার বন্দোবস্ত ছিল এবং বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে পরীক্ষা করে দেখান হত। আমার মনে আছে স্কটিশচার্চ কলেজে পড়বার সময় বিখ্যাত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী যখন ক্লাশে আসতেন তখন নানা পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান পড়াতেন।পরীক্ষাগারে যেসব পরীক্ষা করানো হত তার সঙ্গে পাঠ্যসূচীর সম্বন্ধ ছিল। তাই পাঠ্যবস্তুকে হৃদয়ঙ্গম করতে কোন অসুবিধে হত না। মফঃস্বলের কলেজেও এইরকম পরীক্ষা করে পড়াবার চল ছিল। তাছাড়া, ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বিজ্ঞান পড়াবার শিক্ষকের সংখাও যথেষ্ট ছিল। এছাড়া, প্রতিটি কলেজে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিভাগে ল্যাব এসিসট্যান্ট থাকতো যারা পরীক্ষার ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করত। ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরেই বিজ্ঞানের কঠিনতর বিষয়ে প্রবেশ করত।
পঞ্চাশের দশকের শেষে বোঝা গেল যে আমরা বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ছি অন্যান্য অগ্রসর দেশের তুলনায়। তখন এগারো বছরের উচ্চমাধ্যমিক কোর্স চালু করা হল। তখন উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয় যুক্ত হল।সব রাজ্য কিন্তু এই ব্যাবস্থা চালু করল না। কিন্তু এইসব উচ্চতর বিষয় পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক বা ল্যাব কর্মী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছিল না। ইন্টারমিডিয়েট কলেজগুলিকে ডিগ্রি কলেজে পরিণত করা হল। ভারতের সমস্ত প্রদেশ কিন্তু এই প্রথা চালু করেনি। পশ্চিমবঙ্গ করেছিল।সেখানেও উপযুক্ত শিক্ষক ও ল্যাবরেটারীর সমস্যা দেখা দিল। এর ফলে বিদ্যালয়গুলির বিজ্ঞান শিক্ষার মান নেমে গেল। ডিগ্রি কলেজগুলিতেও এই সমস্যা দেখা দিল।
এই ব্যাবস্থা আশির দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত চলল। তারপর আবার ব্যাবস্থার পরিবর্তন করা হল এবং এখনকার উচ্চমাধ্যমিক কোর্স চালু করা হল।ডিগ্রী কোর্স তিন বছরই রয়ে গেল। অর্থাৎ, গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পেতে গেলে এক বছর বেশি পড়তে হবে। প্রথমের দিকে কিছু কিছু কলেজেও উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো হত। কয়েক বছর পর শুধু বিদ্যালয়েই উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো শুরু হল। কিন্তু, বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানোর পরিকাঠামোর কোন পরিবর্তন করা হল না। কোনও ল্যাব এসিস্ট্যান্ট দেওয়া হল না। এমন বিদ্যালয়ও আমি দেখেছি যেখানে উচ্চমাধ্যমিক খোলা হয়েছে কিন্তু কোন ল্যাবরেটারী নেই। পাঠ্যসূচীর আধুনিকীকরণের ফলে ডিগ্রি কোর্সে যা পড়ানো হত তার কিছু কিছু নবম-দশম শ্রেণীতে আনা হয়েছে। অথচ, তার জন্য কোন ল্যাবরেটারির বন্দোবস্ত নেই। এর ফলে আগে যে সমস্ত সহজ সহজ পরীক্ষা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক করে দেখাতেন তা বন্ধ হয়ে গেল। এর দুটো কারণ বলা হয়। এক, পাঠ্যসূচী ভারী হয়ে গেছে। এবং দুই, যার ফলে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় পাওয়া যায় না। যদিও, আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এসব বাধা সত্ত্বেও শ্রেণীকক্ষে পরীক্ষা করে বিজ্ঞান পড়ানো যায়। এইরকম পরীক্ষা বেশিরভাগ মাস্টারমশাইরা করেন না পড়াবার সময় তার কারণ পরীক্ষা করার কোন অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। তাঁদের পড়াশুনোও হয়েছে মুখস্থ বিদ্যার মধ্যে দিয়েই। হাতে-কলমে কাজের কোন অভিজ্ঞতাই নেই। টেক্সটবুক, নোট দিয়ে মুখস্ত করিয়ে যদি ৮০-৯০ পাওয়া যায় তাহলে আবার পরীক্ষা করার প্রয়োজন কি? মস্তিস্কের এক আলস্যলালিত জড়তা কাজ করে এবং ‘চক ও টক’ উপায়ে পড়ানো চলছে ভারতের বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে। প্রচুর তথ্য, সংজ্ঞা বিদ্যার্থীদের মুখস্থ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার পেছনে কার্যকারণ সম্বন্ধ না বুঝেই। শিশুদের মধ্যে কৌতূহল, জানার আগ্রহ, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, প্রশ্ন করার ক্ষমতা বা সমস্যা উত্থাপন ও সমাধান করার ক্ষমতা সৃষ্টি হচ্ছে না। বিজ্ঞান শিক্ষার ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাই বিদ্যার্থীরা যখন উচ্চমাধ্যমিকে যায় তখন তার বিরাট পাঠ্যসূচির চাপে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং দিশেহারা হয়ে অনেকে পড়া ছেড়ে দেয়।
আজ থেকে সাত-আটশ বছর আগে শিক্ষার কী আদর্শ ছিল তা অবাক করার মত। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় “History of Hindu Chemistry” লিখছেন ১৯০৩ সালে। ঐ গ্রন্থে তিনি ১৩-১৪ শতাব্দীত লিখিত “রসেন্দ্রচিন্তামনি” গ্রন্থে রামচন্দ্র লিখছেন,“ That which I have heard of learned men and have read in the Sastras but have not been able to verify by experiment I have discarded. On the other hand those operations which I have, according to the direction of sage teachers, been able to perform with my own hands-those alone I am committing to writing. Those are to be regarded as real teachers who can verify experiments what they teach-those are to be regarded as laudable disciples who can perform what they have learnt.-teachers and students other than those are mere actors on the stage”। আজকের বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের বইয়ের লেখক, শিক্ষক ও ছাত্রী-ছাত্ররা শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়েছে না পিছিয়েছে?
বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে এই অবস্থার ফলে বিদ্যার্থীদের উৎসাহ কমে যাচ্ছে। বহু বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে।এই সমস্যা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা ভারতে। বেশ কয়েক বছর আগে বিড়লা মিউজিয়মে একটি প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে এসে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ সি এন আর রাও বলেছিলেন যে অবস্থা আজ বিজ্ঞান শিক্ষায় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত তাতে ভালো বিজ্ঞান গবেষণা বিপর্যস্ত হবে। আমরা যদি শিশুকাল থেকে শিক্ষার বুনিয়াদকে শক্ত করতে না পারি গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই পঙ্গু হয়ে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ গাইছেন, “আকাশভরা, সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান”। একই কথা বলছেন আইনস্টাইন,“ Wonder is the source of all arts and sciences. A person who has lost the sense of mysterious is a burnt out candle”। শিশুর মধ্যে সেই বিস্ময়বোধ জাগ্রত করতে হবে তার আশপাশের পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলতে আমরা কি বুঝি?ঃ পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ, তার কোন প্যাটার্ন আছে কিনা দেখা, তার থেকে প্রকল্প (hypothesis)তৈরি করা, প্রকল্পকে পরীক্ষা করা এবং তা থেকে তত্ত্ব তৈরি করা এবং তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের পূর্বাভাষ (prediction) দেওয়া। বিজ্ঞানের সত্যকে কখনোই ধ্রুব সত্য বলে ধরা হয় না। এটি ধরেই নেওয়া হয় যে তত্ত্বকে ভুল প্রমান করা সম্ভব। তাই বিজ্ঞানে কোন গুরু নেই, ধর্মগ্রন্থও নেই। বিজ্ঞানের গুরু ও ধর্মগ্রন্থ পাল্টে পাল্টে যায়।কখনো অ্যারিস্টটল, কখনো নিউটন, কখনো আইনস্টাইন।
বিজ্ঞান গতিশীল এবং ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারনশীল। একটি উর্দু কবিতা বিজ্ঞানের জগৎকে খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করে।কবিতা বলছে, “এই জীবন একটি দীর্ঘ যাত্রা, তা যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছয় তখন গন্তব্যস্থল দূরে বিলীন হয়”। সত্যিকারের বিজ্ঞানচেতনা মানুষকে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক চেতনা শিশুকে পৃথিবীকে বুঝতে এবং পরিবর্তন করতে শেখাতে পারে।
উপরোক্ত কথা মনে রাখলে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার পাঠক্রমের উদ্দেশ্য, বিসয়, শিক্ষন পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন কি হবে?ঃ
প্রাথমিকে (ছয় থেকে নয়) শিশু আনন্দের মধ্যে দিয়ে তার আশপাশের জগৎকে আবিষ্কার করবে তার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করবে।বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুর সঙ্গে প্রকৃতির বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে।শিশুর মনে বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে কৌতুহল সৃষ্টি করা, পর্যবেক্ষণ করা, অন্বেষণ করা, নিজের হাতে কাজ করা যাতে সে পর্যবেক্ষণ, শ্রেণীকরণ এবং তার থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।এতে তার বোধের বিকাশ ঘটে এবং মানসিক ক্রিয়া সংক্রান্ত গতি (psychomotor skill)বাড়ে।বিখ্যাত শিক্ষা মনস্তত্ত্ববিদ Jean Piaget বলছেন শিশুর বোধের বিকাশে স্তরভেদ আছেঃ ০ থেকে ২ বছর পর্যন্ত হচ্ছে sensory motor stage যখন শিশু তার পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে জগৎকে অনুধাবন করে। ২ থেকে ৭ বছর হচ্ছে pre operational stage যখন শিশু কার্যকারণ সম্বন্ধে অনুধাবন করতে শিখছে কিন্তু কোন ধারনামূলক বোধ(conceptual understandi-
ng) আসে না। ৭ থেকে ১১ বছর হল concrete operational stage যখন বোধের বিকাশ হচ্ছে কিন্তু বিমূর্ত(abstract) চিন্তার ক্ষমতা আসছে না। যেমন চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে প্রায় ৩০ দিনে একবার ঘোরে এবং চাঁদ ও পৃথিবী একসঙ্গে সূর্যের চারিদিকে বছরে একবার ঘুরে আসে। আবার চাঁদের কক্ষতল এবং পৃথিবীর কক্ষতল ৫ ডিগ্রি কোণ করে থাকে এবং এরই ফলে প্রতি পূর্নিিমায় সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ হয়না এটা বোঝা ১১ বছরের আগে শিশুর বোঝা সম্ভব হয় না। ১১ থেকে ১৪ হল formal operational stage যখন শিশুর বিমূর্ত ধারণা বোঝবার ক্ষমতার সৃষ্টি হয়।
প্রাথমিকে শিশু বিভিন্ন রকম সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত হবে-গান, নাচ, ছবি আঁকা, কাগজ-মাটি-প্লাস্টিসিন দিয়ে নানা জিনিষ গড়া, মাপজোকের ধারণা ইত্যাদি। ভাষার ভিত্তি স্থাপন হবে। যেমন, শোনা,বলা,লেখা,পড়া এবং সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ।অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সাস্থ্য ও পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় হবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
উচ্চ-প্রাথমিক পর্যায়ে (১১ থেকে ১৪) বিজ্ঞানের বিষয় শিখতে শুরু করবে, পরীক্ষা করতে, মডেল গড়তে শিখবে।তার পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বিভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে জানবে। বৈজ্ঞানিক বোধের বিকাশ হবে পরীক্ষা ও কাজের মধ্যে দিয়ে।দলে কাজ করা, বিদ্যার্থীদের মধ্যে যারা পড়াশুনোয় ভাল এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা, তথ্য আহরণ করা এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহাণ করা।শিশুদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বৎসরান্তে পরীক্ষার বদলে নিরবিচ্ছিন্ন সামগ্রিক মুল্যায়ন (continuous comprehensive evaluation) পদ্ধতি চালু করতে হবে যাতে শিশুর সামগ্রিক বিকাশ হয়। এ সবই এন সি আর টি-এর ২০০৫ সালের National Curriculum Framework(NCF)-এ বলা আছে।
মাধ্যমিক স্তরে(নবম ও দশম শ্রেণী) বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় পড়াবার সময় হাতে কাজ করা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।মনে রাখতে হবে চিনা প্রবাদ বাক্য, যা বোধহয় শিক্ষাপদ্ধতির নির্যা্স, যা বলে,“আমি পড়ি আমি ভুলে যাই, আমি দেখি আমি মনে রাখি এবং আমি করি আমি বুঝি”। তত্ত্বগত বিষয়কে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে।কক্ষে যখন মাস্টারমশাই পড়াতে আসবেন তখন পরীক্ষা করে %A