হার্ভার্ডের গণকেরা

অক্টোবর ২০১৮
-গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

জ্যোতির্বিদ্যার ক্লাসে আমাদের তারাদের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে পড়তে হয়। এ বিষয়ে সবচেয়ে পরিচিত নাম হল ‘হার্ভার্ড শ্রেণিবিভাগ’, যা গত একশো বছরের জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কলেজের সঙ্গে যুক্ত মানমন্দিরে ব’সে এই কাজের সিংহভাগ করেছিলেন এমন একজন, যাঁকে প্রথমদিকে প্রায় কেউই বিজ্ঞানী ব’লেই স্বীকার করত না। তিনি একা নন। সেই সময় হার্ভার্ড মানমন্দিরেই একদল মানুষ কাজ করতেন যাঁদের কাউকেই বিজ্ঞানী মনে করা হত না। তার একমাত্র কারণ তাঁরা সবাই ছিলেন মহিলা, অথচ তাঁদের গবেষণা ছাড়া আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার জন্মই হত না। দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের কাজের স্বীকৃতি আদায় ক’রে নিয়েছিলেন। তাঁদের নিয়েই এই লেখা।

হার্ভার্ড শ্রেণিবিভাগের গুরুত্ব কী সংক্ষেপে দেখা যাক। রঙ এবং নির্গত আলোর বর্ণালীর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিচার ক’রে তারাদের কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়। O শ্রেণির তারারা সবচেয়ে নীল। তারপর B, A, G, F, K এবং M – এই শ্রেণির তারারা ক্রমশ নীল থেকে লালের দিকে যায়। নক্ষত্রের বর্ণালীর অন্য যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যকেও শ্রেণিবিভাগ করতে কাজে লাগানো হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল হাইড্রোজেনের শোষণ বর্ণালীর তীব্রতা। পর্যবেক্ষণের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিশেষ ধরণের মহাজাগতিক বস্তুর জন্য পরে আরও কয়েকটি শ্রেণি যুক্ত করা হয়েছে। এই শ্রেণিবিভাগ তৈরি হয়েছিল গত শতাব্দীর ঠিক শুরুতে। প্রথম থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করতেন যে, এই শ্রেণিগুলো তারাদের উপরিতলের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। এই বিভাগ না-থাকলে নক্ষত্ররা কোন উপাদান দিয়ে তৈরি, তাদের ভৌত অবস্থা ও গঠন ইত্যাদি জানা সম্ভব হত না। মেঘনাদ সাহা এবং পরে তাঁর সমীকরণের উপর নির্ভর ক’রে অন্য বিজ্ঞানীরা এ-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন। সেই গল্পের সামান্য কিছু অংশ এই লিঙ্কে পাওয়া যাবে।

‘হার্ভার্ড শ্রেণিবিভাগ’, এই নামটা এলো কোথা থেকে? সাধারণত যে বিজ্ঞানীর গবেষণা, তাঁর নামই এই ধরনের নামকরণের সময় ব্যবহার করা হয়, যদিও ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা ‘সাহা সমীকরণ’-এর কথা ভাবতে পারি। আবার তারাদের ঔজ্জ্বল্যকে ‘হার্ভার্ড শ্রেণিবিভাগ’ অনুযায়ী সাজালে একটা বিশেষ ধরণের চিত্র পাওয়া যায়। ডেনমার্কে ব’সে বিজ্ঞানী এইনার হার্জস্প্রুং ও আমেরিকাতে বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল প্রথম তারাদের এইভাবে সাজিয়েছিলেন ব’লে এই চিত্রকে তাঁদের দুজনেরই নাম যুক্ত ক’রে বলা হয় ‘হার্জস্প্রুং-রাসেল চিত্র’। ১৯১০ সালের এই গবেষণা তারাদের গঠন সম্পর্কে গবেষণায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তাই হার্ভার্ড শ্রেণিবিভাগ বিজ্ঞানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার নামকরণে কোনো বিজ্ঞানীর নাম যুক্ত নেই।

অনেক সময় এমন হয় যে কোনো এক বিশেষ গবেষণার সঙ্গে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের অনেক বিজ্ঞানী একসঙ্গে যুক্ত থাকেন, সেজন্য সকলের নামের পরিবর্তে ওই বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামে গবেষণাটিকে চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু তাও হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু ক’রে বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়কাল ধ’রে সমস্ত কাজটা করেছিলেন একজনমাত্র গবেষক অ্যানি জাম্প ক্যানন। তাঁর কাজকে স্বীকৃতি দিলেও সেই যুগ তখনই তাঁকে বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকার করেনি। হার্ভার্ড মানমন্দিরে একদল মহিলা একসঙ্গে কাজ করতেন, তাঁদের একত্রে বলা হত ‘হার্ভার্ড কম্পিউটারস’। আমরা যাকে কম্পিউটার ব’লে চিনি, এই কাহিনি সেই যন্ত্রগণক আবিষ্কারের অনেক আগের ঘটনা। এখানে কম্পিউটার অর্থে যিনি গণনা করেন অর্থাৎ গণক।

কর্মরত হার্ভার্ডের গণকরা

হার্ভার্ডের এই গণকদলের সৃষ্টির পিছনেও আছে এক মহিলার দান। ১৮৮২ সালে মারা যান শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডাক্তার হেনরি ড্রেপার। তিনি নাক্ষত্র বর্ণালী বিশ্লেষণ ক’রে তারাদের মধ্যে কী কী মৌলিক পদার্থ থাকে তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁর বিধবা স্ত্রী মেরি স্বামীর গবেষণাকে সম্পূর্ণ করবেন ব’লে স্থির করেন। কিন্তু এ-কাজ কোনো একজনের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। স্বামীর বন্ধু হার্ভার্ড মানমন্দিরের ডাইরেক্টর এডওয়ার্ড পিকারিঙের সঙ্গে কথা ব’লে তিনি ১৮৮৬ সালে স্বামীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য হার্ভার্ড মানমন্দিরে একটা দূরবিন ও কিছু অর্থ দান করেছিলেন। পিকারিং দেখেন যে, কাজ অনেক কিন্তু অর্থের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। তিনি তখন স্থির করলেন যে, পুরুষের পরিবর্তে মহিলাদের দিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেট পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও তা লিপিবদ্ধ করানো যেতে পারে। তাঁদের অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে ঘণ্টা পিছু পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ সেন্ট দেওয়া হত। এই মাইনেটা ছিল একই কাজে নিযুক্ত পুরুষদের অর্ধেক এবং একজন কেরানির থেকেও কম। কম্পিউটারদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যাতে স্নাতক, কিন্তু তাঁদের রোজগারের পরিমাণ আলাদা ছিল না। তাঁদের কাজ ছিল অনেকটাই গতানুগতিক ধরণের। অ্যানি ক্যানন ছাড়া তাঁদের কারও দূরবিন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশের ছবি তোলা হত। সেই ছবি ডেভেলপ ক’রে তাকে বিশ্লেষণ করতে হত। তার থেকে জ্যোতিষ্কদের অবস্থান, রঙ ও ঔজ্জ্বল্য মেপে তা রেকর্ড করতে হত। এই সমস্ত কাজের সময় বায়ুমণ্ডলের প্রতিসরণ ইত্যাদি হিসাবে রাখতে হত। শুধু হার্ভার্ড নয়; সুদূর পেরু, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড সহ আরও অনেক জায়গায় তোলা ছবি হার্ভার্ড মানমন্দিরে পাঠানো হত। বিভিন্ন সময়ে সেখানে সব মিলিয়ে আশি জনের বেশি মহিলা এই কাজ করেছেন। তাঁরাই তৈরি করেছেন আকাশের জ্যোতিষ্কদের এক পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র। এঁদের মধ্যে যাঁর নাম প্রথমেই আসে তিনি উইলামিনা ফ্লেমিং। হার্ভার্ড থেকে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় নক্ষত্র বর্ণালীর ড্রেপার তালিকা। তালিকাতে ১০৩৫১-টি তারাকে বর্ণালী অনুসারে ভাগ করা হয়েছিল মূলত হাইড্রোজেনের শোষণ বর্ণালীর তীব্রতা অনুসারে। এই তালিকা অ্যানি ক্যাননকে সাহায্য করেছিল। ফ্লেমিং ড্রেপার তালিকার অধিকাংশ কাজটা করেছিলেন। তা স্বীকার করলেও প্রকাশনার প্রথম পাতায় বা ভূমিকাতে তাঁর নাম দেওয়া হয়নি। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত জ্যোতিষ্কদের অপর এক তালিকা ড্রেয়ার ক্যাটালগে তাঁর অবদান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাঁর নামের উল্লেখ ছিল না। পরে অবশ্য তাঁকে কিছুটা হলেও সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া হয় – পরের বছর ড্রেয়ার ক্যাটালগের নতুন সংস্করণে উইলামিনা ফ্লেমিঙের নাম স্থান ক’রে নেয়। ফ্লেমিঙের জীবনের গল্প রূপকথার মতো। স্বল্পশিক্ষিতা স্বামীপরিত্যক্তা মহিলা জীবিকার সন্ধানে স্কটল্যান্ড থেকে পাড়ি দেন আমেরিকা। তখন তিনি গর্ভবতী। চাকরানির কাজ জুটল পিকারিঙের বাড়িতে। পিকারিঙের সহকারী ছিলেন এক পুরুষ গণক, কিন্তু তার কাজ পিকারিঙের পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে উইলামিনাকে সেই কাজ দেন। সালটা ছিল ১৮৮১। ন’বছরের মধ্যে দশহাজার নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণ করেন ফ্লেমিং! একইসঙ্গে তিনি হার্ভার্ড মানমন্দিরের হাজার হাজার ফটোগ্রাফিক প্লেট গুছিয়ে রাখার এক পদ্ধতি তৈরি করেন যাতে প্রয়োজন হলে সহজেই যে কোনো প্লেট খুঁজে পাওয়া যায়।

উইলামিনা ফ্লেমিং

সারাজীবনে ফ্লেমিং ৫৯টি গ্যাসীয় নীহারিকা, ৩১০টি ঔজ্জ্বল্য পরিবর্তনশীল বা ভেরিয়েবল নক্ষত্র ও ১০টি নোভা আবিষ্কার করেছিলেন। তিনিই প্রথম শ্বেত বামন নক্ষত্র আবিষ্কার করেন। এখন আমরা জানি যে, শ্বেত বামন হল কম ও মাঝারি ভরের তারাদের জীবনের শেষ দশা। এদের উপর গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর। সেই গল্প এখানে পাওয়া যাবে। ১৮৯৯ সালে তাঁকে হার্ভার্ড মানমন্দিরের সমস্ত ফটোগ্রাফের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯০৭ সালে তিনি লন্ডনের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সদস্য পদ পান, তিনিই প্রথম মার্কিন মহিলা সদস্য। পেনিসিলিনের আবিষ্কর্তা আলেকজান্ডার ফ্লেমিঙের সঙ্গে তাঁর কোনো আত্মীয়তা না থাকলেও তাঁদের দুজনের সম্মানে চাঁদের বুকে এক গহ্বরের নাম রাখা হয়েছে ফ্লেমিং। এবার যাঁর কথা বলব, তাঁর অবদান ছাড়া মহাবিশ্ব বিষয়ে আধুনিক গবেষণা সম্ভব হত না। হেনরিয়েটা সোয়ান লেভিট ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাডক্লিফ কলেজের স্নাতক। হার্ভার্ড মানমন্দিরে তিনি কাজ শুরু করেন ১৮৯৩ সালে। পরিবর্তনশীল নক্ষত্র বিষয়ে উইলামিনা ফ্লেমিং, অ্যানি ক্যানন, হেনরিয়েটা লেভিট সবাই কাজ করেছিলেন। হেনরিয়েটা এদের মধ্যে এক বিশেষ শ্রেণির নক্ষত্র, ‘সেফিড ভেরিয়েবল’-দের নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঔজ্জ্বল্য কেমনভাবে বাড়ে কমে। আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে কাছের দুটি ছোটো ছোটো ছায়াপথকে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দেখা যায়। আধুনিক যুগে ভূপর্যটক ফার্দিনান্দ ম্যাজেলান তাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন ব’লে তাদের বলা হয় ‘ম্যাজেলানের মেঘ’। লেভিট এই দুই ছায়াপথের সেফিড ভেরিয়েবল তারাদের সর্বোচ্চ ঔজ্জ্বল্য ও বাড়া-কমার কালের মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পেলেন। দেখলেন যে, ঔজ্জ্বল্য যত বেশি হয়, তাদের পরিবর্তনকালও তত বেশি হয়। অর্থাৎ সেফিডের পরিবর্তনকাল মেপে ফেললে তার ঔজ্জ্বল্যও জানা হয়ে যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে লেভিটের এই কাজের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ দূরের জ্যোতিষ্কদের দূরত্ব মাপার মতো কঠিন কাজকে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহজ ক’রে দিয়েছিল। কোনো তারার প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য যদি আমরা আগে থেকে জানি, তাহলে তা আমাদের কাছে কতটা উজ্জ্বল লাগে তা মেপে সহজেই সে কত দূরে তা বার করে ফেলতে পারি। মার্কিন বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ১৯২২-২৩ সালে অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথে সেফিড ভেরিয়েবলদের পরিবর্তনকাল মেপে ঐ ছায়াপথের দূরত্ব মেপে বার করেন পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ। এই বিশাল দূরত্ব থেকেই বোঝা গেল – অ্যান্ড্রোমিডা আমাদের ছায়াপথের বাইরে অন্য একটা ছায়াপথ, কারণ আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে দূরের নক্ষত্রও কেন্দ্র থেকে একলক্ষ আলোকবর্ষের বেশি দূরে নয়। অল্প দিনের মধ্যেই দেখা গেল, আমাদের ছায়াপথ মহাবিশ্বে আরো অনেক ছায়াপথের মধ্যে একটা। তার আগে পর্যন্ত প্রচলিত ধারণা ছিল যে, যত জ্যোতিষ্ক আমরা দেখতে পাই সবাই আমাদের ছায়াপথের অঙ্গ।

হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দিরের সামনে অ্যানি ক্যানন ও হেনরিয়েটা লেভিট

এখানেই শেষ নয়। হাবল এরপর বিভিন্ন ছায়াপথের দূরত্ব মেপে দেখেন যে, তাদের থেকে আমাদের যতখানি দূরত্ব, ঠিক তার সমানুপাতী বেগে তারা আরও দূরে স’রে যাচ্ছে। এর থেকেই বুঝতে পারা গেল আমাদের মহাবিশ্ব আসলে প্রসারণশীল। ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের কথা এভাবেই বিজ্ঞানীদের মাথায় আসবে। বর্তমানে আমাদের ধারণা হল যে, মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্বের জন্ম, তা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে; অসংখ্য ছায়াপথ ক্রমশই পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; এই চিত্র লেভিটের গবেষণা ছাড়া সম্ভব ছিল না। তাঁর গবেষণার এই ফল দেখার জন্য লেভিট অবশ্য জীবিত ছিলেন না। তিনি ১৯২১ সালে হার্ভার্ডে ঔজ্জ্বল্য মাপার বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। কিন্তু সেই বছরেই ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু হয়। জীবৎকালে সেরকম কোনো স্বীকৃতি না-পেলেও একটা গ্রহাণু ও চাঁদের বুকে একটা গহ্বরের নাম তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে। চাঁদের বুকে আরো একটা গহ্বর অপর এক হার্ভার্ড গণক অ্যান্টনিয়া মরি-র স্মৃতি বহন করে। দুটি তারা যদি পরস্পরকে খুব কাছে থেকে প্রদক্ষিণ করে, তাহলে দূরবিনে তাদের আলাদা করা যায় না। কিন্তু বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, সেখানে দুটি তারা আছে এবং তাদের কক্ষপথ সম্পর্কেও অনুমান করা সম্ভব। এদের বলে ‘স্পেক্ট্রোস্কোপিক’ বা বর্ণালীবিশ্লিষ্ট যুগ্ম তারা। প্রথম এইরকম তারাযুগ্ম খুঁজে পেয়েছিলেন অ্যান্টনিয়া মরি। অ্যানি জাম্প ক্যাননের নামে দেওয়া আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির পুরস্কার পেয়েছিলেন মরি। অ্যানি জাম্প ক্যানন যাঁর নামে এই পুরস্কার, তাঁর গবেষণার কথা দিয়েই এই লেখা শুরু হয়েছিল। ক্যানন বিজ্ঞানে স্নাতক, জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মাস্টার্সও করেন। ১৮৯৬ সালে তিনি হার্ভার্ডে কাজ শুরু করেন। গণকদের মধ্যে তাঁরই একমাত্র দূরবিন ব্যবহারের অনুমতি ছিল। তারাদের শ্রেণিবিভাগ কেমন করা হবে তা নিয়ে উইলামিনা ফ্লেমিং ও অ্যান্টনিয়া মরির মধ্যে বিতর্ক বেঁধেছিল, ক্যানন তার মীমাংসা ক’রে মাঝামাঝি এক পদ্ধতি অবলম্বন করেন। ১৯০১ সালে তাঁর নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে ১১২২ নক্ষত্রের তালিকা প্রকাশ করেন অ্যানি ক্যানন। পরবর্তীকালে নক্ষত্রদের ‘হেনরি ড্রেপার তালিকা’-র বেশ কয়েকটি খণ্ড প্রকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সারাজীবনে সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি নক্ষত্রের শ্রেণি নির্ণয় করেছিলেন অ্যানি ক্যানন! তারাদের শ্রেণিবিভাগের জন্য তৈরি এক আন্তর্জাতিক কমিটিতে তিনি সদস্য হয়েছিলেন। জার্মানিতে কমিটির অধিবেশন বসেছিল। আলোচনা সম্পর্কে অ্যানির সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘কাজটার বেশিটাই আমি করেছিলাম, তাই আমি কথাও বলেছি অন্যদের থেকে বেশি।’ তাঁর সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি ক’রে, সাহা সমীকরণ ব্যবহার ক’রে সিসিলিয়া পেইন দেখান যে – তারারা মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ মহাবিশ্বের মূল উপাদান চিহ্নিত করতে ক্যাননের গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিল। অ্যানি জাম্প ক্যানন পুরস্কারের প্রথম প্রাপক সিসিলিয়া পেইন ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রথম মহিলা ডক্টরেট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যানি ক্যাননের গবেষণা স্বীকৃতি পেয়েছিল। তিনি অক্সফোর্ডের প্রথম সাম্মানিক মহিলা ডক্টরেট। ১৯১৪ সালে তিনি ‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’-র সদস্য হন। তিনিই ‘আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’-র প্রথম মহিলা কর্মকর্তা। হেনরি ড্রেপার পদক পৃথিবীর সেরা জ্যোতির্বিদদের স্বপ্ন, অ্যানি জাম্প ক্যানন প্রাপকদের তালিকাতে প্রথম মহিলা। ১৯৩১ সালে তিনি এই পুরস্কার পান। আরও বহু সম্মান তিনি সারাজীবনে পেয়েছিলেন। তবে হার্ভার্ড তাঁকে পূর্ণসময়ের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করতে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দেরি করেছিল। মাত্র দু’বছর ঐ পদে থেকে তিনি অবসর নেন। তাঁর নামেও চিহ্নিত হয়েছে চাঁদের বুকে একটি গহ্বর ও একটি গ্রহাণু। ঊনবিংশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের শুরুতে মহিলাদের গবেষণার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। সেদিক দিয়ে দেখলে হার্ভার্ড মানমন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া কারোর পক্ষে সৌভাগ্যের কথা বলতেই হবে। পিকারিং কিছুদিন পর থেকেই প্রকাশনাতে মহিলা গণকদের নাম যোগ করা শুরু করেছিলেন। তিনি সে যুগের তুলনায় যথেষ্ট অগ্রসর ছিলেন, মেয়েদের ভোটাধিকারের সপক্ষেও তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। পিকারিং ও তাঁর পরের ডাইরেক্টর হার্লো শেপলি-র উদ্যোগেই হার্ভার্ড মানমন্দির মহিলাদের বেশি সুযোগ দিত, সেখানকার ডক্টরেট প্রোগ্রামের শুরুতে প্রথম তিনবছর শুধু ছাত্রীদের নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এই স্বীকৃতি কারো দয়ার দান ছিল না। হার্ভার্ডের আশি জন গণকের মধ্যে অধিকাংশের নাম আমরা মনে রাখিনি। যেমন ১৮৯০ সালের ড্রেপার তালিকাতে ফ্লেমিং ছাড়া আরও আটজন মহিলার কথা লেখা আছে, যাঁরা গণনাতে সাহায্য করেছিলেন – ফ্লোরেন্স কুশম্যান, এডিথ গিল, ইভলিন লেল্যান্ড, আনা উইনলক, ম্যাবেল স্টিভেন্স, অ্যানি মাস্টার্স, জেনি রাগ এবং লুইসা ওয়েলস। এঁদের সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। গণকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হার্ভার্ড মানমন্দিরে কর্মরত পুরুষদের আত্মীয়। আনা উইনলক ছিলেন মানমন্দিরের ডাইরেক্টর জোসেফ উইনলকের মেয়ে।। বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ার পরে সংসার চালানোর জন্য তিনি ১৮৭৫ সালে ঘণ্টায় পঁচিশ সেন্ট হারে মাইনেতে কাজ শুরু করেছিলেন। ইতিহাস তাঁদের সকলের নাম মনে রাখুক বা না-রাখুক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে তাঁদের ভূমিকাকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।

Add Comments